খোকা দেখলো জনৈক ছাত্রনেতা কোমরে একটি হ্যান্ডেল লাগিয়ে এবং অপর একটি হাত স্প্রিং-এর মতো নেড়ে নেড়ে অনর্গল তুবড়ি ছোটাচেছ, এরা কারা? আপনাদের মতো আমাদেরও ওই একই প্রশ্ন, এরা কারা? জনতা এদের চেনে? এদের কি কোনো পরিচয় আছে জাগ্রত জনতার সঙ্গে? পরিচয় নেই। জনতা এদের চেনে না। এরা বিবরবাসী। মুক্ত আলোবাতাস থেকে বঞ্চিত এইসব হতভাগ্য অভিশপ্তরা। জনসাধারণের সঙ্গে এদের কোনো সংশ্রব নেই, দেশের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুসংখ্যক বিপথগামী উন্মাদ। সস্তা বিপ্লবের ধুয়ো তুলে এই হঠকারীর দল মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে আপনাদের। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই–
একফাঁকে সরে পড়লো খোকা। দিনের পর দিন সকাল-বিকেল-দুপুর চিরতার পানির মতো এইসব গিলছে উৎসাহীর দল; ভগ্নোদ্যমকে সেঁকে নিচ্ছে। ফাঁপা আস্ফালন ও বাধাগতের বুলি আওড়ানো, আর কিছু শেখে নি এরা এর বাইরে। দেশের বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতির সত্যিকার চেহারা কোনো বক্তৃতাতেই নেই, এদের ঘৃণা করে খোকা, এরা লোভী, ধূর্ত, শঠ, প্রবঞ্চক, সমগ্র রুচিকে এরা বিকৃত করে তুলেছে।
পা ঘষাঘষি করতে করতে শেষ পর্যন্ত নীলাভাবীদের ওখানে গেল খোকা। রাজীব ভাই বাইরে। নীলাভাবী বললে, নিতে এসেছো?
এখনো ইচ্ছে আছে?
তার মানে?
আমি ভেবেছিলাম কথার কথা।
এতোকিছুর পরও?
এতোকিছু আবার কিসের, টেকনিকটা তো পুরানোই—
বাজে কথা বলো না, নিয়ে যাবে কি না বলো?
বিছানায় গা এলিয়ে দিলো খোকা। দুটো বালিশ টেনে গাড়ের নিচে চালান করে হেসে বললে, যদি তুমি আমার মাথা চিবিয়ে খাও–
খাবোই তো!
আসল কথা তোমাকে নিয়ে ভাগতে পারবো না!
খারাপ কথা বলবো কিন্তু!
এ আর নতুন কি–
নীলাভাবী খোকার হাত চেপে ধরলো। বললে, ভেবেছো ঠাট্টার ছলে সব উড়িয়ে দেবে, আমি সব বুঝি, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে।
খোকা গা ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বললে, আমি তোমার কে? আমার ওপর এতো অধিকার খাটাতে চাও কেন? আমি তোমার মুটে-মজুর নই, কোনো বোঝা নিতে পারবো না, সাফ কথা!
আমি কি সত্যিই বোঝা? কি করে বলতে পারলে?
তুমি সিনেমায় নামো না কেন?
বিছানার এক পাশে বসে থোকাকে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে দিলো নীলাভাবী। বললে, আমি বুঝতে পারছি নিজের ওপর তোমার তিলবিন্দু আস্থা নেই। সে না হয় হলো, এতো ভয় পাচ্ছো কেন, আমি বাঘ না। ভালুক, তোমাকে বুঝি গিলে খাবো?
অসম্ভব কিছু নয়। নিজের ওপর আস্থা থাকলে অসময়ে এই বান্দাকে সেগুনবাগিচায় কোনো শালা দেখতো না। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি তুমি আমাকে জাদুটোনা করেছো, পানসুপুরি ছেড়েছো, তোমার মতলব খারাপ!
নীলাভাবীর চোখমুখ দপ করে উঠলো একথায়। বললে, মাঝে মাঝে তুমি এমন কদর্য কথা বলো! আগে তো এমন ছিলে না। এসব নোংরা ইয়ার্কি তুমি অন্য কোথাও মেরো, আমার কাছে না!
নীলাভাবীর একথায় তেজ ছিলো। এই তেজ খোকাকে স্পর্শ করে। এই তেজ খোকাকে তার নিজের মতো করে পথ দেখায়। শেকড় বাকড়হীন এই সমস্যাকে এইখানেই এই মুহূর্তে শেষ করে দিতে হবে, তাকে নেবার প্রশ্ন যেন আর কোনোদিন মাথা তুলে চাড়া না দেয়, খোকা। আলো দেখতে পায়। সে ওঠে বসে বললে, ভণিতা ছেড়ে সোজা রাস্তায়। এসো, কি চাও কি তুমি, কেন এ খেলায় মেতে উঠেছো? রসাতলে নিয়ে যেতে চাও বুঝি আমাকে?
নীলাভাবী স্তম্ভিত হয়ে দীর্ঘ দৃষ্টিতে খোকার দিকে তাকালো।
খোকা বললে, তুমি নিজেকে শাসন করো, অশ্লীলতা বিকৃতি স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংস করে দেবে তোমাকে; এভাবে ছত্রাখান কোরো না। নিজেকে। আমি তোমার ভালো চাই, আমি তোমার বন্ধু। যদি বলো চিরকাল বন্ধু থাকবো, আমি চাইবো তোমার ভালো হোক। নিজের হাতে তোমাকে নষ্ট করবো, ভাবো কি করে, আমার ভিতরে শুধু লাম্পট্যই দেখলে,–
কাকে ভালোমন্দ বলছো? তোমার কাছে শিখতে হবে ভালোমন্দ?
সে তোমার ইচ্ছা! আমি শুধু বলছি আমার অক্ষমতার কথা। আমি যা পারবো না আমার কাঁধে তা চাপাতে যেও না!
তার মানে আমি তোমার কাছে দয়ার কাঙাল!
তুমি ইচ্ছে করে এইভাবে দেখছো—
কিভাবে আমার স্বেচ্ছাচারিতাকে দেখলে, বিকৃতিকে চিনলে?
কথা ঘুরিয়ো না। আমি যা বলছি তুমি তা বুঝেছো। ভান কোরো না না-বোঝার। আগুন ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না, হাত পুড়ে যাবে, মুখ ঝল্সে যাবে। তুমি যে সুখ-শান্তির কথা ভাবো সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও তা কখনো কেউ পাবে না, এ আমি জানি। শান্তি রচনা করতে হয়। নিজেকে সংযত করো, নিজেকে শাসন করো–
চমৎকার! থামলে কেন, বলো, আরো বলো!
বলবো না কেন, তুমি আমাকে বলাচ্ছো। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা করো না। যেদিন তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেদিন তোমার ভিতর এ বিকৃতি ছিলো না; কতো স্নিগ্ধ ছিলে তুমি, আমার কাছে সেটাই ছিলো তোমার আকর্ষণ। ভেবে দ্যাখো, আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছো, কিভাবে মানসম্মান আত্মগরিমাকে জলাঞ্জলি দিতে বসেছো?
তাহলে আমি এই?
হ্যাঁ, তুমি এই; তোমার সুবুদ্ধি নেই, সংযম নেই, হিতাহিতজ্ঞান নেই, আত্মশাসন নেই, ভেবে দেখেছো কখনো এর শেষ কোথায়?
বুঝতে পারছি খুব বেশি আশা করে ফেলেছি আমি তোমার কাছে!
এখন দেখছো একজন প্রতারক, এই তো?
বুঝতে পারি না। তোমার মতো এতো সহজে আমার মাথায় কিছু ঢোকে না। কোনুটা ভণ্ডামি আর কোনটা ভালোমানুষি সেটা তুমিই জানো। শুধু বুঝতে পারছি আমার চরিত্র নেই, চরিত্রকে হাটে-বাজারে বন্ধক দিয়েছি, লজ্জায় তোমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে!