রঞ্জুর ভালোমন্দ নিয়ে মাথাব্যথার আর শেষ নেই মুরাদের। কি বোঝাতে চায় মুরাদ। ইয়াসিনের সামনে এমনভাবে রঞ্জুর কথা পেড়েছিলো যেন কতোদিনের সম্পর্ক ওর রঞ্জুর সঙ্গে। রঞ্জুর ব্যাপারে এই প্রবল উৎসাহের পিছনে যুক্তিটা কি, খোকার তা বোধগম্য নয়। সহ্যের সীমা পার করে দিচ্ছে মুরাদ, ওকি শেষ দেখতে চায়?
এ এক ধরনের শত্রুতা। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু পাকাচ্ছে কি না তা-ই-বা কে বলবে, নির্লজ্জ বেহায়া, মতলব কি ওর! রঞ্জুর ভালোমন্দ নিয়ে আকাশ ভেঙে পড়ছে ওর মাথায়। কে ওকে অধিকার দিয়েছে? পাত্তা না পেয়ে ভিন্ন পথে হিসেব করে এগোতে চায় মুরাদ। মরিয়া হয়ে উঠছে জানোয়ারটা; ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকে খোকার মাথা। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে একসময়।
খোকা পায় পায় রঞ্জুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নখ কাটতে বসেছিলো
আমার কাছে দে–নেলকাটার নিয়ে নেয় খোকা, পা বাড়িয়ে দে দেখি এদিকে।
কুটকুট করে রঞ্জুর পায়ের নখ কাটতে থাকে খোকা। রঞ্জুর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। রুপোর তোড়া পায়ে ঘরময় ঝুমঝুম করে ছুটে বেড়াতো রঞ্জু, শখ করে মা পরিয়েছিলো। কি ছিচকাঁদুনেই না ছিলো সে সময়। তাকানো যেতো না ওর দিকে; সবসময় দ্যাখো ঠোঁট ফুলিয়ে আছে, ছলছল করছে চোখজোড়া; যেন কতো না ওর দুঃখ, দুনিয়ার সবাই বিরাট এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে ওর কাঁধে।
নখ কাটতে কাটতে ওর পায়ে ছোট্ট একটা চাপ দিলো খোকা, বললে, এই বাঁদরী, ছোটোবেলায় টম্যাটো বললে ভ্যাঁ করে কেঁদে ভাসাতিস কেন রে?
বললেই হলো!
তোর বোধহয় মনে নেই।
ফাঁক পেলেই তুই আমার কান মলে দিতিস, আর আমি মার কাছে নালিশ করতাম–
তখন তোর কানজোড়া বেজায় ছোটো ছিলো, টেনে টেনে আমিই লম্বা করেছি!
গুলবাজ! নিজের কথা মনে নেই তোর? বুড়ো ধামড়া হয়েও তুই বিছানায় পেচ্ছাব করতিস। একবার তোকে কাপে করে পেচ্ছাব খাওয়ানোও হয়েছিলো, মার মুখে তোর সব কেচ্ছাই আমি শুনেছি।
আর কেন্নো দেখলেই তুই যে চিংড়ি ভেবে গপ করে গালে পুরতিস, তারপর ক্যাঁচম্যাচ চিবিয়ে খেতিস–
ইশ, সত্যি বলছিস দাদা?
তবে কি? গাল ফুলে যেত, জিভ ফুলে যেত, চুন লাগিয়ে দিতো মা। তুই কি কম জ্বালিয়েছিস মাকে?
আহা, নিজে কতো লক্ষ্মী ছেলেটিই না ছিলে! ন্যাড়ারাজামার্কা গিনি দিয়ে চিনেবাদাম কিনে খেয়েছিলো কে? কেমন পিটুনি পড়েছিলো পিঠে?
এমন গবামার্কা ছিলি যে ইস্কুলের ক্লাসে বসে বসে গাল বন্ধ করে খোসাসুদ্ধ চিনেবাদাম খেতিস, যাকে বলে একদম গাধা!
তোর পায়ে একবার কাঁকড়াবিছে কামড়েছিলো, মনে আছে?
ইশ, সেকি হুলস্থুল কাণ্ড! মা ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, ভেবেছিলো বুঝি সাপে কামড়েছে!
অনেকক্ষণ পর খোকা বললে, তোর ভয় করছে?
তোর?
তোর জন্যে আমার ভয়। চল কোথাও রেখে আসি তোকে—
রঞ্জু হেসে বললে, পায়ের নখ কেটে দেবে কে তাহলে?
সময় হলে আমি কেটে দিয়ে আসবো।
আমাকে কাটাতে পারলে তোর বোধহয় মস্ত সুবিধে হয়, তাই না? ইচ্ছেমতো খোকামি করে বেড়াতে পারবি–
একশোবার—
বুড়োবাড়ি হলেও এখনো তুই নিজেকে খোকা মনে করিস, এটাই তোর দোষ!
আর তোর দোষ কোটা জানিস, ওর উল্টোটা। একফোঁটা পুঁচকে ছুঁড়ি তার আবার এতো কথা কিসের!
খুব সাবধানে নখের ধার মারতে থাকে খোকা ফাইলিং করে। খোকার মনে হয় এই তো সেই রঞ্জু, এ আমার কতো চেনা, রুপোর তোড়াপরা ঝুমঝুমি বাজানো ছোট্টবেলার সেই রঞ্জু, মুরাদ একে চেনে না, কাব্যচর্চার ঘোড়ারোগ দিন দিন বানোয়াট করে তুলেছে তাকে। রঞ্জুর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে খোকা স্বস্তি পায়, সুস্থ হয়; এমন স্নিগ্ধ এমন নির্মল এমন নিষ্কলঙ্ক হতে পারে কেবল করুণাধারা।
০৮. খোকা ঠিক করেছে দুর্যোগ নিয়ে
খোকা ঠিক করেছে দুর্যোগ নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। সে দেখেছে এতে তার ভিতরের অশান্তি দ্বিগুণতর বাড়ে। জনসভা আর মিছিল করে লঙ্কাকাণ্ড বাধাবার জন্যে কোমর বেঁধে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছে মানুষজন। কাঁধে রাইফেলের কেঠো ডামি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে উৎসাহী ছাত্রদল। সেনাবাহিনীর লোকজন ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। ন্যাবলা-গোবলা বাঙালি সেপাই-সান্ত্রীরা চোখেমুখে ভাই ভাই ভাব নিয়ে প্রাণের আনন্দে ট্রাকে ট্রাকে ঘুরে নামকে ওয়াস্তে পাহারাদারি করে বেড়াচ্ছে; হাবভাব দেখলে মনে হয় হাতে কলকে এসে গিয়েছে, এখন কেবল গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো।
বিকেলে আউটার স্টেডিয়ামে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলো খোকা। দেখা হলো রহমান আর নুরুদ্দিনের সঙ্গে। রহমান উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, খেলা জমে গেছে, এবার শালারা বোম ফেলাট হয়ে যাবে–
ময়ানে এখানে-ওখানে জটলা। কোনো একজন বক্তা বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ভাইসব, সময় নষ্ট করবেন না, আপনারা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ন, আজ আপনাদের সম্মুখে কেবল একটি পথই খোলা, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। কালবিলম্ব না করে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে আপনাদের, আঘাত হানতে হবে শত্রুকে। এতোদিন যে বিপ্লবকে মনে হয়েছিলো পর্বতের মতো ভারি, আজ তা পালকের চেয়েও হালকা, মুক্তির একমাত্র পথই হলো সশস্ত্র বিপ্লব, এই পথই বেছে নিতে হবে আপনাদের–
লে ধড়ফড়াকে! জনসভার বাইরে বাঙ দিয়ে উঠলো একজন।
স্টেডিয়াম গেটের পাশে টিকিট ঘরের ছাদে আসন গেড়ে বসে ফুকফুক করে সিগ্রেট ফুঁকছিলো ছাত্রনেতারা। ময়দানের মানুষজন হুড়মুড় করে ছুটে এসে জমায়েত হলো সেখানে।