সবই ভুসিমাল, ঘটনাচক্রে একবার ঘেঁটে দেখেই সে বুঝেছে। গোটা মানব সমাজটাই ভুসিমালের কারবারি, সমজদার। খোকা জানে, এই নীলাভাবীরা তাদের দীর্ঘ বিলম্বিত যৌবন নামক দেহসম্ভারকে লোকচুক্ষর সম্মুখে যতো মজবুত গদরেজের সিন্দুকেই আগলে রাখার অভিনয়পটুতা দেখাক না কেন, তাদের ঘরের সব দেয়ালই ফুটো, সব দরজাই অর্গলহীন, জানালাগুলো খোলা, হাহা। উদোম রাস্তাও বাইরে থেকে হাঁ করে দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের এমব্রয়ডারি দেখতে থাকে। সেই একদিনই, কিন্তু তবু সে তো তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখেছিলো। সবকিছু। এখন গা শিরশির করে ভাবতে গিয়ে। যাকে আমরা দেহ বলি, শরীর বলি, রাজভোগ বলি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ বলি, ঘোড়ার ছাই বলি, আসলে তা নিছক প্রয়োজনের জিনিশ, খোকা ভেবে দেখেছে প্রয়োজন ব্যতিরেকে এক কানাকড়িও তার মূল্য নেই, তার কাছে নেই। ভাতের মাড় গালা মালসা, ঘরমোছা ন্যাতাকানির তাল, কিংবা জঞ্জাল ফেলার আঁস্তাকুড়, শরীর কি এর অতিরিক্ত কিছু; ডোম-চাড়াল কাওরা-মুচি থেকে শুরু করে কুষ্ঠরোগীরও প্রয়োজনের বস্তু এই শরীর!
হাওয়ায় রঞ্জুর এলোমেলো চুল উড়তে থাকে। ঘাড় মুখ সুড়সুড় করে খোকার। দুপাশের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে তার নীলাভাবী মনে হয়, সেগুন নীলাভাবী, অশথ নীলাভাবী, পিপুল নীলাভাবী, কৃষ্ণচূড়া নীলাভাবী, সুঠাম পতিতাশ্রেণী, দেহ বিক্রয় করবে এরা সবাই।
মনে মনে দর কষাকষি করতে থাকে খোকা।
পিপুল নীলাভাবী, তুমি কতো নাও?
তোমার উদ্যম!
কৃষ্ণচূড়া নীলাভাবী, তোমার কতো?
তোমার রত্নরাজি!
অশথ, তুমি?
তোমার সৃজনশীলতা, তোমার আনন্দ, তোমার স্বপ্ন, তোমার গৌরব, এইটুকুই। আর আমার বকশিশ, তোমার ভীষণ চোখ–
বিতৃষ্ণা কুপোকাত করে ফেলে খোকাকে। মনে হতে থাকে জীবনে আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না, তার মেরুদণ্ডের হাড় চুরচুর হয়ে গিয়েছে, ছিড়ে জট পাকিয়ে গিয়েছে স্নায়ুতন্ত্রী; মাথার ভিতরে বেআইনি কারখানা ফেঁদেছে শয়তান, বকযন্ত্রে কেলাসিত হচ্ছে পুঁজরক্তের এক ভীষণ আরক, রাসায়নিক গন্ধে তার নাড়ি ঠেলে আসে।
তবে কি নীলাভাবীর সন্তানের প্রয়োজন তার আছে? কেন তাকে এভাবে টানছে? সন্তানের পিপাসায় এমন টালমাটাল বল্গাহীন হতে পারে মেয়েরা? বরং একটা যুক্তি হিসেবে ধরে নিলে অনেক অসঙ্গতির জট খুলে যায় এতে। নীলাভাবী যদি তাকে সন্তান উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য যন্ত্র বলে ধরে নিয়ে থাকে, তাহলে সে ভুল করেছে। খোকার মনে পড়ে একজোড়া বিবশ অর্ধনিমিলিত চোখের ছবি, যার ভাষা কোনো অক্ষরে সে পড়ে নি এ যাবৎ, একটি হাতের বেষ্টন কিভাবে ঠোঁটের নরোম উষ্ণতায় টেনে নিয়েছিলো, ছোবল মেরেছিলো, বিষ ঢেলেছিলো, এইসব; প্রতিটি নিশ্বাস ছিলো তন্ত্রসিদ্ধ, আগ্নেয়। গড়ান খেয়ে খেয়ে সে ভৈরবীচক্রের মাঝখানে গিয়ে পড়েছিলো, কামকুণ্ডের তপ্ত কটাহে নাড়িভুঁড়ি বিছা আর শিয়ালের রক্তের সঙ্গে সমানে টগবগ করে ফুটেছিলো।
নিজেকে উপপতির সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখে ঘৃণায় কুঞ্চিত খোকা। ঠিক উপপতিও নয়। সে মনে করে এই বিশেষ্যে কাছাকোচা আছে, জুড়িগাড়ি আর বাগানবাড়ি আছে, আতরের গন্ধ খুনখারাবি আর হীরার নেকলেস আছে। বরং একটা টাইমের বাবু, মাকড়া।
কি অতো ভাবছিস? জিগ্যেস করে রঞ্জু।
কি করবো ভাই ভাবছি।
বাপি না ফেরা পর্যন্ত কোথাও নড়তে পারবো না আমরা, খামোকাই তুই ভাবছিস।
ঠিকই বলেছিস। একটু থেমে খোকা জিগ্যেস করলে, কেমন লাগলো তোর এদের সবাইকে?
ভালোই তো–
তার মানে তোর পছন্দ হয় নি! পছন্দ-অপছন্দের কি আছে, আমি তো আর তোর জন্যে কনে। দেখতে যাই নি। ওরা তো ভালোই, মিশুক–
তবু ভালো, তোকে নিয়ে আমি কিন্তু বেশ চিন্তায় ছিলাম। আমি নিজেও ভেবে পাই না ওদের সঙ্গে আমার এতো খাতির কিভাবে হলো, এমন সাদামাটা একটা ফ্যামিলি!
রঞ্জু খোকার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব নরোম করে বললে, তোর উপর যথেষ্ট দুর্বলতা আছে নীলাভাবীর, ভীষণ স্নেহ করেন তোকে। বাপরে বাপ, প্রশংসা শুনতে শুনতে কানমাথা ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিলো আমার।
খোকা তাচ্ছিল্যভরে বললে, আরে বাদ দে, আমি এসব গায়েই মাখি। আসলেই নীলাভাবীটা একটা জ্বালাতন, ঝঞাট। নীলাভাবীর সব ভালো, শুধু স্বভাবটা একটু গায়েপড়া। ছেলেপিলে হয় নি বুঝলি না, এখনো কিছু কিছু ছেলেমানুষি আছে, বুড়িখুকি আর কি!
কি যা-তা বলছিস, তোর মাথায় সত্যিই ছিট হয়েছে–শাসনের সুরে রঞ্জু বললে, সবকিছু খারাপভাবে দেখছিস কেন এ রকম? মেয়েদের সম্পর্কে ফটাফট মুখে যা আসে তা বলবি না, কি এমন জানিস তুই! কতো স্নেহ করেন তোকে, অথচ যা মুখে আসছে তাই বলছিস, অবহেলার ভাব দেখাচ্ছিস, তুই একটা খেটেচাষা! এই জন্যে মাঝে মাঝে তোর উপর আমার রাগ হয়!
খোকা অসহায়ের মতো ভেঙে পড়ে কাতরভাবে বললে, রঞ্জু তুই আজকাল আমাকে বড় বকাঝকা করিস, সামান্য একটা খুঁত পেলেই হলো। আমি তোর দুচোখের বিষ, দেখতে পারিস না তুই আমাকে–
রঞ্জু হেসে ফেললো। পোড়া পেট্রলের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছিলো বলে নাকমুখ রুমাল দিয়ে ঢেকেছিলো সে। রুমালটা দিয়ে খোকাকে একটা বাড়ি মেরে বললে, কচিকোকা, কোকাবাবু, কাঁদে না বাবু কাঁদে না—
০৭. পরদিন খুব সকালে মুরাদ এলো
পরদিন খুব সকালে মুরাদ এলো, সঙ্গে ইয়াসিন। খোকা তখন বারান্দায়। বসে বসে সে পাখির ডাক শুনছিলো। এতো পাখির ডাক এর আগে সে আর কখনো শোনে নি। পাতার আড়ালে গা লুকিয়ে চোখগেল আর বউকথাকও ডাকছে এখন।