বলো, তুমি বুঝতে পারো নি—
কিন্তু কোথায় যেতে চাও?
যেখানে খুশি, যেখানে তুমি নেবে, যেখানে আনন্দ, শুধু এই কবর থেকে আমাকে বের করো। সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে, মনে হয় সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেই, তছনছ করে দেই, তারপর ছুটে বেরিয়ে যাই দু চোখ যেদিকে যায়–
দু একদিনের জন্যে হাওয়া বদল করে কি কোনো লাভ হবে, হয়তো আরো এলোমেলো হয়ে পড়বে মনের অবস্থা। ফিরে এসে আরো অসহ্য ঠেকবে সবকিছু তখন কি করবে?
সে তখন দেখা যাবে।
খোকা বললে, কি লাভ, এইভাবে অশান্তি বাড়িয়ে?
লাভ-লোকসানের কথা ভেবে শিকল তুলে বসে থাকতে পারবো না। লাভ করতে নেমেও তো লোকে লোকসান করে। আমাকে নিয়ে তোমার অতো ভাবতে হবে না, তুমি পারবে কি না বলো–
খোকা নিস্পৃহ কণ্ঠে বললে, দেখি, কি করা যায়!
ক্ষেপে উঠলো নীলাভাবী। বললে, আমি তোমার কাছ থেকে আধো আধো বুলি শুনতে চাই নি, পষ্ট জবাব দিতে হবে তোমাকে!
খোকা তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, তাই বলে সুবিধে-অসুবিধের কথা ভাবতে দেবে না?
এতো ভাবাভাবির কি আছে, তুমি তো আর আমাকে নিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছো না!
তুমি কি তাই চাও?
এতো বেশি চাওয়া যায় না। যার কাছে চাইবো তার নিজেরও কিছু দেয়ার ক্ষমতা থাকা চাই।
খোকা বললে, আমিও তাই বলি, নিজের উপরে আমার কোনো আস্থা নেই। তোমার কাঁধে এখন সৃষ্টিছাড়া নেশা চেপেছে, তুমি ছেলেখেলায় মেতে উঠেছে, পরে পস্তাবে, শুধু কাদা ঘাঁটাই সার হবে!
আমার ভালোমন্দ নিয়ে অতো চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আমি শুধু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। কেন আমি তিল তিল করে নিজেকে এমন কষ্ট দেবো, দেখাই যাক না স্বার্থপর হতে পারি কি না। যেভাবে খুশি, যেখানে খুশি, তুমি আমাকে নিয়ে চলো, যেভাবে খুশি আমাকে কিছুদিনের জন্যে রেখে দাও, আমি আমার ভিতকে নড়াতে চাই–
খোকা মুমূর্ষু কণ্ঠে বললে, তোমার সংসার?
আগে ভেবেছিলাম ভালোবাসার জন্যে মানুষ সংসার করে! চায়ের কাপ থেকে চেয়ার-টেবিল, সুই-সুতো থেকে খাট-পালঙ, কি না নেই সংসারে, শুধু ঐ ভালোবাসা বস্তুটি ছাড়া। অথচ সংসারের ভিতরে দাঁড়িয়ে কি অহঙ্কারটাই না আমাদের, দেখে যাও কতো কিছু নিয়ে এই সংসার, কি না নেই এখানে! থুতু দিতে ইচ্ছে করে আমার, ইচ্ছে করে ঝাড়ুর বাড়ি মারি। জানালার কাচ ঝাপসা হলে মোছো, ঘরে ঝুলকালি ধরলে সাফ করো, হাঁড়ির তলার কালি মেজেঘসে ওঠাও, নরদমা সাফ করো, শুধু শিকেয় তুলে রাখো মনকে, দেখার দরকার নেই তার গায়ে ঝুলকালি পড়েছে কি না, সিটিয়ে যাচ্ছে কি না! সংসারের তুমি কতোটুকু জানো! একটা গালভরা বুলি, লাশটানা খাটিয়া! এইসব দেখতে দেখতে আমি বিষিয়ে উঠেছি, শুধু আসবাবপত্র; মরা কাঠ, মরা লোহা, মরা কাচ, শাড়ি কাপড়ের গাঁটরি-বোঁচকা, ঝাড়ু মারি আমি এসবে। দিনের পর দিন নিজেকে ফতুর করে কেবল এইটুকু বুঝেছি মানুষ সংসার পাতে শুধু চার হাত-পায়ে ভালোবাসাকে মারতে। শুধু চুলোচুলি, খুন-খারাবি, ছুরি মারামারি, অথচ তুমি বলতে পারবে না, বলার নিয়ম নেই। সাজসজ্জা করে ঢেকে রাখো। শুধু এই একটা কৌশল শেখার জন্যেই দিনের পর দিন রক্ত পানি করো, কি করে এসব ঢেকে রাখবে, লোকচুক্ষকে ফাঁকি দেবে।
খোকা বললে, ঠিক আছে, এখন তুমি যাও তার ভয় ছিলো যে কোনো মুহূর্তে রাজীব ভাই অথবা রঞ্জু এসে পড়বে এবং সে বিপদে পড়ে যাবে।
এই প্রথম খোকা দেখলো নীলাভাবীকে হতাশায় ভেঙে পড়তে। একটু একটু করে গাঁথুনি ধসে পড়ছে ভিতরের, রুগ্ন মানুষের চেহারা এখন নীলাভাবীর। তা হোক, ঘোলা আর জটিল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মতো মানসিক স্থৈর্য খোকার এখন নেই।
এক সময় রঞ্জুকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় সে। বেবিট্যাক্সিতে বসে দুপাশের অপসৃয়মান গাছপালা আর মানুষজন দেখতে দেখতে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকে। অরণ্যে যেভাবে অতর্কিতে প্রেতায়িত অন্ধকার নামে, মনের মধ্যে সেইভাবে রাত্রি নেমে আসে ঝপ করে। অন্ধকারে কুটিল বনাঞ্চলে পথ হারিয়ে ফ্যালে সে, জটিলতা কখনো বাঘ হয়ে কখনো পাইথন হয়ে ক্রমাগত তার দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।
এক সময় আবার ভর করে নীলাভাবী। এক অদ্ভুত প্রস্তাব! খুব সহজে নিতে পারে না খোকা, আকুলতার চেয়ে আতিশয্যই বেশি এর ভিতর। যদি ট্রাপ হয়, জাহাবাজ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়ে কত ছোকরাই তো ফেঁসে গেল। নাকি সাপের মতো পাকে পাকে তাকে জড়াতে চায় কোনো কদর্য অভীষ্ট সিদ্ধির অভিপ্রায়ে। একদিনের একটি দুর্বল মুহূর্তকে মূলধন করে স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠেছে নীলাভাবী; তার ধ্যান-ধারণার স্বাস্থ্য এইভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। নীলাভাবী হয়তো নিজের ঠুনকো বিশ্বাসকে এইভাবে দৃঢ় করেছে, তার শরীরের মতো লোভনীয় খোকার কাছে আর কিছুই নেই। কামগন্ধী স্থলনের পিচ্ছিল দুপুরকে মুঠোয় ভরে আত্মবিশ্বাসের গজদন্ত মিনারকে গগনচুম্বী করে তুলছে নীলাভাবী।
দেহ কি? শরীর কি?
খোকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নারীদেহ সম্পর্কে যতো বিশেষণই প্রয়োগ করা হয়ে থাক না কেন, আসলে তা নিছক তাল তাল গোবরের মতো মাংস ছাড়া আহামরি এমন কিছু নয়; স্পষ্ট মনে আছে খোকার, সেদিন সেই চরম মুহূর্তের পর কিভাবে গ্লানিতে ভরে গিয়েছিলো তার মন। অবসন্নতায়, মনহীনতায়, নিরাসক্তিতে, সে দুমড়ে পড়েছিলো যখন দেখলো সারা গায়ে দুর্গন্ধ নিয়ে প্যাঁচপেচে ভাগাড় থেকে নেড়িকুত্তার মতো সে উঠে আসছে।