মনে হচ্ছে সমস্যায় ফেলে দিয়েছি তোমাকে।
সমস্যা মনে করলেই সমস্যা! এড়ানোর চেষ্টা করে খোকা।
এই সময় নীলাভাবী ঘরে ঢুকলো, পিছনে রঞ্জু। তরমুজের প্লেট এগিয়ে দিলো নীলাভাবী।
রাজীব ভাই বললে, ঠিক যেন টুৰ্মেলিন। তোমাকে দেখাবো। আশ্চর্য মিল!
একটু পরে পরে সুটকেস খুলে একটা পাথরের চাকলা বের করলো রাজীব ভাই। বললে, এই দ্যাখো, তরমুজের মতো টুৰ্মেলিন। উপরটা সবুজ, তারপর সাদা, তারপর কেমন লালচে। এক সিংহলীর কাছ থেকে জোগাড় করেছিলাম বছর দশেক আগে। সবচেয়ে তাজ্জব কথা কি জানো? একটু থেমে রাজীব ভাই বললে, এই এতোদিন পর হঠাৎ আপনা-আপনিই চিড় খেতে শুরু করেছে, সারমর্মটা বুঝলাম না–
খোকা জিগ্যেস করলে, তোমারও বাতিক কম নয়, পাগলকে সাঁকো নাড়া দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এক্ষুণি ওষুধ গেলানোর মতো গালগপ্পো ফেঁদে বসবে।
ঠিক আছে বাবা, এই আমার মুখে তালাচাবি রাজীব ভাই টুৰ্মেলিন সুটকেসে তুলে রেখে বললে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না!
রঞ্জুর কাঁধে একটা হাত রেখে নীলাভাবী বললে, যা ভালো মেয়ে, এতো ভালো লেগেছে আমার ওকে–
খোকা বললে, বোনটা কার তা দেখতে হবে না!
আকাশ-পাতাল তফাত, এখন বুঝতে পারছি কেন এতোদিন আনোনি। নিজের নাক কাটা যাবার ভয় ছিলো তোমার।
ভালো—
আমার কি ইচ্ছে করে জানো–রঞ্জুর একটা হাত ধরে নীলাভাবী বললে, আমার ইচ্ছে করে ওকে একরাশ পুতুল কিনে দেই, ও খেলুক, সারাদিন বসে বসে তাই দেখি।
খোকা বললে, কিরে নিবি নাকি?
রঞ্জু মুখ টিপে হেসে বললে, যদি সারাদিন খেলতে হয়!
তবেই বোঝ—
সত্যি ওকে আমার এতো ভালো লেগেছে—
ভিতরে ভিতরে ক্ষেপে ওঠে খোকা। সে মনে মনে বলতে থাকে, কাকেই বা অপছন্দ তোমার! তুমি যদি একটা বাইসন হও রঞ্জু একটা হরিণছানা, তুমি লুলু চৌধুরী সব এক গোয়ালের গর, মালটানা গাব্দাগোব্দা লেল্যান্ড ট্রাক-বিশেষ, চাকার তলায় পড়লে খেল খতম, গনফট।
এবার থেকে সবসময় ওকে নিয়ে আসবে–
তা না হলে সুবিধে হবে কেন, ওর মাথাটি ভালো মতন চিবিয়ে খেতে হবে না, পারলে বলেই ফেলতো খোকা, কিন্তু রঞ্জু থাকায় সে বিজ্ঞের মতো নীরবে তাকিয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না।
নীলাভাবীর মাথায় গুচ্ছের চুল। রঞ্জু পাটির মতো বিনুনি করে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে খোকাকে দেখালো নীলাভাবী। খোকার মনে হলো বাড়াবাড়ি, রঞ্জুটাও যেন দিনকে দিন ঠুনকো হয়ে উঠছে, কিসের এতো মাখামাখি, খোকার কাছে এসব প্লাস্টিকের ফুলের মতো খেলো মনে হয়।
খুব সম্ভব সুযোগ খুঁজছিলো নীলাভাবী। একফাঁকে খোকাকে একা পেয়ে ভুরু তুলে জিগ্যেস করলে, কি ব্যাপার, কেমন যেন একটু রাগ রাগ ভাব দেখছি তোমার?
তা তো দেখবেই, খুঁটে ঘা করা যাদের অভ্যেস তারা অমন দেখেই!
আমাকে দেখে তুমি বিরক্ত হও—
তুমি নিজেই একটা বিরক্তি!
নতুন করে কোথাও প্রেমে পড়েছো নাকি?
প্রেম ছাড়া তুমি কি আর কিছু শেখো নি?
বড্ড ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন, কি হয়েছে কি তোমার? ঘাড়ে নতুন কোনো ভূত ভর করেছে, বুঝতে পারছি। চুলোয় যাক, নিয়ে যাচ্ছে তো? কি ঠিক করলে?
আমি কোথায় নিয়ে যাবো?
একটা হাত চেপে ধরলো নীলাভাবী। বললে, তুমি ছাড়া আর কে নিয়ে যাবে? আমি কি বাঘ না ভালুক, যে খেয়ে ফেলবো, না খোপার ভিতর সাপ রাখি? এতো ভয় কেন?
আমি কোনো ল্যাঠার ভিতরে নেই!
আমি বুঝি তাই–
তবে কি! অন্যের ঝক্কি নিজের কাঁধে নিতে যাবো কেন, আমাকে তো আর ভূতে ধরে নি। এ ভারি অন্যায় আবদার!
বড় নিষ্ঠুর তুমি!
সর্বনাশ, এতো অল্পেই তোমার কান্না আসে!
সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলো নীলাভাবী। কান্নায় বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো গলার স্বর।
চোখ মুছে বললে, কারো উপরেই তোমার শ্রদ্ধা নেই, ভেবেছো এই করে সুখ পাবে জীবনে। কোনোদিন পাবে না। দগ্ধে দগ্ধে কালি হয়ে যাবে তোমার অন্তর, কোনোদিন তুমি সুখী হতে পারবে না, কক্ষনো না–
খোকা হেসে নরোম করে বললে, ভারি একটা মানুষ আমি, অথচ ভোজালি গুঁজতে হবে কোমরে; ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখবো কোনো ব্যবস্থা হয় কি না!
বিশ্বাস করো, নীলাভাবী আকুল হয়ে বললে, আমি মরে যাচ্ছি, বিশ্বাস করো খোকাবাবু, আমি মরে যাচ্ছি, আমি হাঁপিয়ে পড়েছি এই সংসারের ভিতর, আর টানতে পারছি না, ঘেন্না ধরে গেছে আমার। এর ভিতরে আর কোনো রস নেই, প্রাণ নেই, দিনরাত কবরের ভিতরে পড়ে আছি, আঁস্তাকুড়ে পড়ে আছি, আর পারছি না এভাবে। আমি তো একটা মানুষ-ই, কতো পারবো আর, শুধু জোড়াতালি, শুধু ভান, এই যে দিনের পর দিন হাবাকালার মতো সংসারের সঙ্গে আঠা হয়ে লেগে আছি এর চেয়ে ঘেন্নার আর কিছু নেই; অন্তত কিছুদিনের জন্যে তুমি আমাকে মুক্তি দাও। আমি পাগল হয়ে আছি একটু আলো-বাতাসের জন্যে–
আমি ভেবেছিলাম অন্য ধাতের মেয়ে তুমি, তোমার গোড়া শক্ত।
শক্তই। শক্ত না হলে এতোদিন ঘর করলাম কিভাবে, এখনো ঘানি টানছি কিভাবে? আমার দোষ কি জানো, আমি অভিনয় করে চলতে শিখি নি। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থা ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে তাই করতে হচ্ছে। এ আমি পারবো না। দিনের পর দিন শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, এই চাও বুঝি তোমরা!
ভিতরে ভিতরে দমে গিয়েছিলো খোকা। থলি ঝেড়ে এমন কিছুই সে পেল না যা দিয়ে এই মুহূর্তে তর্ক জুড়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে, ঘাসকুটো ঝেড়ে ফেলতে পারে গায়ের।
সে বললে, সেদিন কিন্তু তুমি অন্যরকম বলেছিলে—