কি আর করবে, সত্যিকার চেতনা আকাশ থেকে পড়ে না। রাষ্ট্রব্যবস্থার যাঁতাকলে মানুষজনকে এ যাবৎ শুধু পেষা হয়েছে, মাড়াই করা হয়েছে—
খোকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললে, অর্থনৈতিক মুক্তিটুক্তি ওসব হাফসোল দেওয়া কথা, বানিশ করা কথা, যে যার স্বার্থের কথা ভেবে পাগলা হয়ে উঠছে, সবাই ভাবছে যার যার নিজের হাতে চাঁদ পাবে। পোকাপড়া মুখ, পেট বোঝাই হিংসা, নিজেদের বলতে যাদের সম্বল শুধু এইটুকুই তাদের জড়িয়ে খোয়াব দেখার কোনো মানে হয় না। মাথায় বেঁড়ে, চিন্তায় বেঁড়ে, নিজেদের সম্পর্কে কতোগুলো আজগুবি গালগপ্পো সৃষ্টি করে বুক ফুলিয়ে রেখেছে–
যতো কথাই বলো, এবারের ব্যাপার কিন্তু অন্যরকম।
খোকা বললে, যে রকমই হোক, আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি ভাবছি আমাদের কি হবে!
তাহলে দেখ, তোমাকেও ভাবতে হচ্ছে–রাজীব ভাই হেসে বললে, সকলের যা হবে আমাদেরও তাই, রক্ত দেয়ার জন্যে সারা দেশের লোক পাগল হয়ে আছে–
গ্রামে পালাচ্ছে কারা?
এক একজন এক একভাবে রক্ত দেয়। পুশকিনের মতো লোকদের ডুয়েলে রক্ত দিতে হয়; কেননা তাদের শরীরে কোনো হ্যানিবলের রক্ত, আবার মারার মতো লোকেরা। গরম পানির চৌবাচ্চায় শরীর জুড়ে রক্ত দেয়, তাদের শরীর ভরা চর্মরোগ—
একটু ভেবে খোকা বললে, খেয়াল করে দেখেছেন, সারারাত কিভাবে কুকুর কাঁদে?
রাজীব ভাই বললে, আশ্চর্য তো, কালরাত্রে আমিও তাই বলছিলাম নীলাকে, ঘুমনো যায় না, মন হু-হু করে। তার মানে মড়ক একটা লাগবেই। লাগবে নাই-বা কেন, এতো আর সেই গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন নয়–
খোকা তাচ্ছিল্যভরে, কাজ কোরো না, অপিসে যেও না, মাসকাবার হলেই যে যার মাইনে তুলে নাও, চেহারাটা ভালোই আন্দোলনের, এর নাম চূড়ান্ত পাগলামি–
তুমি কি ঠিক করলে শেষ পর্যন্ত, যাচ্ছো কোথাও?
এখনো মনস্থির করে উঠতে পারি নি—
একটা কিছু ঠিক করে ফ্যালো সময় থাকতে; তেমন কোনো বিপাকে পড়ে গেলে দেখবে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
পাবে কি এখনই পেয়েছে—
যদি গ্রামের দিকে যাও, তোমার নীলাভাবীকে সঙ্গে নিও!
আর আপনারা?
আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোথাও নড়া। হাত-পা বাঁধা আমার এখানে। তোমার সিদ্দিকাভাবী খুব সম্ভব আমার কথা মানবে না, কোথাও যেতে বললে যাবে না, ওর উপরে তেমন কোনো জোর নেই আমার, বুঝলে না! খারাপটা চিন্তা করা উচিত, তৈরি থাকা ভালো।
আপনাদের ফেলে নীলাভাবী যেতে চাইবে?
চাইবে না কেন? এ-তো তার ভালোর জন্যেই। অবশ্য অন্য কোথাও ওকে ভেড়ানো কঠিন, তুমি বলেই জোর দিয়ে বলছি।
কোনো ইঙ্গিত আছে কি এ কথার ভিতর? ভিতরে ভিতরে খোকা কিছুটা নাড়া খেল। সে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকায় রাজীব ভাইয়ের মুখের দিকে। খোলা জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রাজীব ভাই; শক্ত চোয়াল ও পুরু ঠোঁটে নির্বিকারত্ব; ঝুলকালির বিন্দুমাত্র ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে হলো না খোকার।
খোকা একটা সিগ্রেট ধরালো। কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে সে নিতে পারছিলো না প্রস্তাবটাকে। রাজীব ভাইয়ের এই শেষের কথাটির গায়ে সে উদাসীনতার গন্ধ পায়; তার অনুভূতি শিরশির করে ওঠে, গায়ে হুল ফোটে। এই ঔদাসীন্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে একটি প্রবল দুপুর; এই দুপুরে তারা ছিটকিনি তুলে দিয়েছে দরোজার, ছিটকিনি খুলে দিয়েছে সংযমের; সংযম ডেকে এনেছে পৈশাচিকতাকে, পৈশাচিকতা কেশর ফুলিয়ে দুঃখকে, দুঃখ ক্যাকটাসের গায়ে। গর্ভপাতের নারকী পুষ্পকে, দংশনে ঘর্ষণে পেষণে লেহনে কামদগ্ধ নিশ্বাসে ও চুম্বনে একটি একটি করে পাপড়ি ঝরে পড়েছে। পুপের, পাপড়ি খসে পড়েছে পায়ের পাতায়, গালে গলায় কটিতটে, কাঁধে বাহুমূলে, নাভিমূলে, মর্মমূলে, আঁখিপল্লবে, অশ্রুর মুক্তাফলে, বদ্ধমুষ্টির শঙ্খে এবং শঙ্খ বের করেছে তার জিহ্বাকে, জিহ্বা সর্পকে, শ্বেতচন্দন কুঙ্কুম আর কাচপোকার টিপে নিজেকে সাজিয়েছে। সর্প, কুঙ্কুম চন্দনকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে তার গায়ে এসে বসেছে দিব্য। প্রজাপতি, শত সহস্র ফুলের নির্দোষ নির্মেঘ অবিচল বিস্মৃতি তার পাখায়–
খোকা দেখলো রাজীব ভাইকে, ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। একদিকে। ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে খোকা, টাল খায়। ভিতরে ভিতরে সে মাছি তাড়ানো মনের আলগা রাশকে কষে চেষ্টা করে; কিন্তু পেরে ওঠে না, বিফল হয়।
প্রতিবারই এরকম হয় খোকার। মনে হয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে, একটি খল দুপুর হাহা করে ওঠে তার সামনে, সে আর তখন পালাবার পথ খুঁজে পায় না। তার অসহায়তার মর্মমূলে এক ঐন্দ্রজালিক অপচ্ছায়ার প্রসারণে উৎসমুখ খুলে যায় স্বপ্নের; অর্গলবদ্ধ একটি কামরার ভিতরে ছোটাছুটি করতে থাকে সে, ডাঙা কই, আবা আবা, আমাকে ছুয়ো না, আবা আবা, আমাকে ধরো না, আমি তোমার জলকে নামি নি, আমি রেডি বলি নি, আবাবা, তুমি চু ছেড়েছো, তোমার চু ভেঙে গেছে, তোমার নীলসুতো ছিড়ে গিয়েছে চুয়ের, তোমার তার কেটে গিয়েছে। চুয়ের, পাখনা ঝরে গিয়েছে তোমার চুয়ের, আবা আবা–
এইভাবে বুড়ি ছোঁয়ার চেষ্টা করে খোকা, বুড়ি খোঁজে। ডাঙা খোঁজে। ভিতরে এতো পাঁক, গা ঘিন ঘিন করে খোকার, মরা গুগলির খোল আর পচা খড়কে, কুটিকাটি, ভাঙা কলসির কানা, ভাঙা কাচ, নীলাভাবীর হিলহিলে পিচ্ছিল হাসি; তার কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়ায়!
কি ভাবছো?
রাজীব ভাই স্থির দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
না তেমন কিছু না—