বেরুবোর আগে মুখ কালো করে ফেলেছিল রঞ্জু। বলেছিলো, না বেরুলে চলে না?
তোর অসুবিধেটা কি?
আমার ভয় করে। পাড়াটা কেমন থমথমে হয়ে আছে…
একবার মনে হলো খোকার, থাক, কোথাও গিয়ে কাজ নেই; কিন্তু ঘরে ফেরাও এই মুহূর্তে তার পক্ষে অসম্ভব। সমস্ত ব্যাপারটা খোকার কাছে নিছক খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার মতো কিছু একটা মনে হয়, মিছিলের মানুষগুলোর মুখে দুরারোগ্য অসুস্থতার অক্ষর পড়তে থাকে সে। কোনো স্তরের মানুষের সঙ্গেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কেমন একটু ভিন্নধাতে গড়া আমি খোকা মনে মনে নিজেকে সামাল দিতে থাকে, কি ঘটছে না ঘটছে আমি তার কোনো তোয়াক্কাই করি না, অথচ ফুটপাতের পানওয়ালা থেকে মাটিকাটা কামলারাও কমবেশি কিছু না কিছু বলতে সক্ষম; সময় বদলে দেয় মানুষকে, অথবা মানুষই কান মুচড়ে চাঙ্গা করে তোলে প্রাণশক্তি-বিবর্জিত নির্জীব সময়কে, এবং আমি কোনো কিছুর ভিতর নেই। দেশ, দেশের কল্যাণ, দেশের ভবিষ্যৎ, দেশপ্রেম, এসবের মাথামুণ্ড কিছুই তার মগজে ঢোকে না। এইসব ভজকট ব্যাপারে নিরর্থক অপচয়িত না হয়ে বরং শিথিল আলসেমির ভিতর ডুবে থাকা ঢের ভালো, অন্তত নিরাপদ তো বটেই। রিকশার হাওয়া ছেড়ে দেয়া, বাসে আগুন ধরানো, পুলিশের গায়ে ইট মারা, দেশের প্রতি নিজের প্রগাঢ় অনুরাগকে তুলে ধরার এতো অসংখ্য তীব্র ও আকর্ষণীয় পথ চারপাশে ছড়ানো থাকলেও কখনোই সে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না, আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা তার হাত-পা। পঁয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় চোর-ছ্যাচড় গাঁটকাটারাও ফৌত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলো, দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলো ব্যাটারা; কেউ কারো পকেট কাটে নি, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বিলকুল বন্ধ ছিলো, সময় গিয়েছে একটা। রাজনৈতিক সঙ্কট কি নতুন কোনো ব্যাপার, শয়তানি আর বজ্জাতি কবে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। মানুষ! মানুষ, অর্থাৎ শয়তানের সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, সে কখনো তোমাকে বাছা বলে হাতে তুলে খাটি ছানার রসগোল্লা খাওয়াবে না; যদি গেলাতে চায়, তার আগেই সাবধান হতে হবে।
খোকার ভিতরে একটা বিশাল মাঠ ধু-ধু করে জেগে উঠলো, সেখানে লোলচর্ম নীতিবাগীশদের চিড়-খাওয়া কবর; কিংবা ঠিক তাও নয়, সে স্বস্তি পায় বিরোধিতায়, এটা তার এমনই একটি আত্মনিমগ্ন স্বভাব যার মর্মোদ্ধার কোনোদিনই সে করবে না। খোকা জানে আর পাঁচজনের মতো গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয়। ট্যানারি শ্রমিকরা রাজনীতির বোঝেটা কি, গিনিপিগ এক একটা। হাতের কবজিতে যারা সর্দি মোছে, এখনো যাদের পা গড়িয়ে পেচ্ছাব পড়ে, সেইসব হাফপ্যান্ট পরা ইস্কুলের গালটেপা ছেলেরাও চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে দীক্ষা দিচ্ছে। কোথায় আমেরিকা কোথায় চীন আর কোথায় ফৈজুদ্দিন ব্যাপারি প্রাইমারি স্কুলের লালট-মার্কা ছেলে; কোন অন্ধকারে বসে কে বিধাতার মতো কলকাঠি নাড়ছে ওরা তার সবকিছু বোঝে। ধর্ম আর রাজনীতি ব্যবসার রাঘব-বোয়ালরা ভেজাল ওষুধের কারবারি কিংবা পচা মাছ বিক্রেতার চেয়েও জাতে নিকৃষ্ট—এই জ্ঞান যখন টনটনে হয় ততোদিনে সংগ্রামী ছাত্রজীবনের আয়ুও শেষ, অতএব কোমরে গামছা বেঁধে সি.এস.এস. অথবা ঐ জাতীয় একটা কিছুতে ঝপাং করে লাফ না দিলে পাপস্খলনের সুযোগ তাদের জন্যে বারবার ফিরে আসে না। অন্ধের পায়ের পাতার চেয়েও সন্ধানী আর সতর্ক প্রগতিশীল অথবা বামপন্থী গণ্যমান্যদের অনেকেই এখন ইন্টারকনের লোলুপ নিভৃতে বসে কাটিশার্কব্যালেন্টাইনের মাহাত্ম্যের প্রসঙ্গে দূর থেকে নমস্কার করে স্কটল্যান্ডকে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, পুঁজি, মুনাফা, শ্রেণীসংগ্রাম, রিয়েলিটি, গণতন্ত্রের গ্যাঁড়াকল, নিও হ-য, আলট্রা ব-র-ল, এসবও যথারীতি মোচড় মেরে স্থান পায়, এবং পিয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো অতি সহজে সিল্ক খুলে ফেলে মেয়েদের—রাত যখন গভীর হয় কিংবা দিন যখন রাত্রিকালের গভীরতম প্রদেশ বলে ভ্রম হয়; অর্থাৎ বামপন্থী হওয়াই সব কথার শেষ কথা। আইজেনস্টাইনের ছবির প্রসঙ্গ তুলে মুগুর ভাজাভাজি, পাবলো নেরুদার কবিতার চচচ্চডি খাবলানো, পিকাসোর দেয়ালচিত্র নিয়ে গাবাগাবি, এখন আর তেমন দানা বাঁধে না; কেমন যেন স্যাতসেঁতে, মাটি মাটি, ফাঙ্গাস ধরেছে এইসবে, বরং ভেনেসা রেদগ্রেভের নির্ভার স্বপ্ন মঞ্জরিত হয়ে ওঠে, অধিকার করে সবকিছু। সংগঠনের বস্তাপচা কামড়া-কামড়ি খামচা খামচির খবরের মাঝখানে জাব্দা দেয়ালের ফুটো দিয়ে আসা এলসা মার্টিনেলির পায়ের গড়ন আরো বাতাস বৃষ্টির ঝাপটার কাজ করে, সোফিয়া লোরেনের বুকের মাপ বিদ্যুতের অলৌকিক চাবুক হয়ে লেজ নাড়তে শেখায় রিং মাস্টারের নাকের ডগায়; বালকের বিধ্বংসী হাতে রবারের লাল বেলুনের মতো অমন বুক হাতে এলে বিপ্লবকে তিনকুড়ি বছর বস্তাবন্দি করে গুদামে পুরে রাখা যায়।
টনটনে রৌদ্রে হাবার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে এসব কি ভাবছি—খোকা মনে মনে কতকটা কাদা মেখে উঠে এলো। একটা নির্বোধ উত্তেজনা স্নায়ুতন্ত্রীকে আচ্ছামতো কাবু করে ফেলেছে। কিসের প্রত্যাশায় খুঁটিগাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এখানে, নূহের নৌকো আসন্ন কোনো দিগন্ত-প্রবাহী সর্বনাশা জলস্রোত থেকে শস্যবীজের মতো তুলে নেবে বলে, কেন দাঁড়িয়ে আছি, খোকা নিজের ওপর বিরক্ত হয়। সবকিছু সহজভাবে নিতে