খোকা বললে, মহাদুর্দিন সামনে সবাই বলছে, আমার মাথায় তো কিছুই আসে না। এতোসব আলাপ-আলোচনারই-বা দরকার কি? এক একবার মনে হচ্ছে সব মিটমাট হয়ে যাবে, কখনো মনে হচ্ছে সবটাই একটা ফাঁকি, কোনটাকে ছেড়ে কোনটাকে বিশ্বাস করবো বুঝি না!
সিগ্রেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান মারতে লাগলো রাজীব ভাই। রাজীব ভাইয়ের রুক্ষ চোয়াল বিশ্রীভাবে ঠেলে বেরিয়েছে, দাড়ি না চঁচায় পাগল পাগল চেহারা। গর্তে বসা চোখ, দুশ্চিন্তার রেখা কপালে।
খোকা বললে, শেষ পরিণতিটা কি, বুঝতে পারছেন কিছু?
আমি কেন, নেতারাও সেকথা স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। বুঝলে না, আমাদের নেতারাও অনেক সময় বুঝতে পারে না, তারা দাবার খুঁটিমাত্র, তাদের চালা হচ্ছে।
আর সাধারণ মানুষ, তারা?
মোটের ওপর তারা অতো ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। যে অর্থে তারা স্টেডিয়ামে চীনা এ্যাক্রোব্যাটদের শো দেখতে যায়, ঠিক সেই অর্থেই কিংবা সেই উদ্দীপনা নিয়েই পল্টনের মাঠে নেতাদের লেকচার শুনতে জড়ো হয়। যদি একদিকে স্বাধিকার আর অপরদিকে সস্তায় দুগজ লংক্লথ। দেওয়া হয়, তাহলে আগে লংক্লথের লাইনেই তারা মারপিট করবে তবে সাধারণ মানুষ আমূল পরিবর্তন চায়, একথাও সত্যি–
খোকা জিগ্যেস করলে, এ সম্পর্কে তাদের ধারণাটা কি রকম—
কারো সামনেই কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেই। সকলের দৃষ্টিই ঘোলা, আচ্ছন্ন হওয়ার কথা তো এই রকমই; একে জানা নেই লেখাপড়া, তার ওপর দিনের পর দিন তারা প্রতারিত হয়েছে, চোখ ফুটবে কোত্থেকে? রাজনৈতিক দলগুলোর কথা ভেবে দেখ, কেবল নিজেদের প্রয়োজনে তারা জনসাধারণকে ব্যবহার করছে এইমাত্র, আর কোনো দায়দায়িত্ব ছিলো না কারো কখনো–
একটু থেমে রাজীব ভাই বললে, এখন যে অবস্থা চলছে তাতে খুব বড় করে এইটুকুই বলা যায় আঁধার হাতড়ে বেড়ানো মানুষজন এখন কিছুটা ঐক্যবদ্ধ; এটা যদি ভেস্তে যায় দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে
কিন্তু এর পিছনেও তো দলীয় স্বার্থ রয়ে গেছে!
তা থাকুক, সব কথা ফেরানো যায় না। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এই ঐক্যকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে হবে।
খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে বললে, ঐক্যটাকে এতো দাম দিচ্ছেন কেন, গোঁজামিল নেই, ফাঁক নেই এর ভিতর?
হয়তো আছে, কিন্তু একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না–
খোকা বললে, আপনি হুজুগেপনাকে ঐক্য বলে মনে করছেন। যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেয়ার সময়ও এই হুজুগেপনা ছিলো, আয়ুব খান যেদিন প্রথম আসে স্টেডিয়ামের ভিড়ের কথা মনে আছে আপনার? এরা তো তারাই, সেই মানুষজনই!
কথাটা ঠিক, কিন্তু একটা যুগ পার হয়ে গেছে এরপর। একথা ভুললে চলবে না। ঐক্যটা এবারে রাষ্ট্রবিপ্লবের চেহারা নিয়েছে, বলতে পারো আগুন ঘাঁটাঘাঁটি; ঘাড়ের উপরের মামদোরা কিভাবে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে চিন্তার কথা সেটাই। খেয়াল করলে দেখবে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যতো রকমেই দেশকে শাসন করা হয়ে থাকুক না কেন তার কোনোটাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না, সব সময় একটা সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা ছিলো তার ভিতর। এখনো আছে, পরেও থাকবে, ওরা চেষ্টা করবে রাখার–
রাজীব ভাই বালিশ টেনে নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় কাত হলো। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর বললে, কিন্তু এখানে ও কথা আছে। ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানের কথা ভুললে চলবে না। ওরা যা কিছু করুক, যে মাস্টার প্ল্যানই থাকুক না কেন, ঐ অভ্যুত্থানকে সামনে রেখেই তার আলোকে সবকিছুর ব্যবস্থা নিতে হবে। ওর চেয়ে অনেক অর্থবহ, অনেক ভয়াবহ ধরে নিতে হবে এবারের দর কষাকষিকে! ওটা যদি একটা ধাপ হয়ে থাকে এটা দ্বিতীয় ধাপ। এখন মানুষজনের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি, তারা জেনে গেছে ইচ্ছে করলেই, ঐক্যবদ্ধ হলেই, তারা দেশের শাসনযন্ত্রকে একেবারে বিকল করে দিতে পারে–
খোকা চটে উঠলো। সে বললে, আপনি সংবাদপত্রের মতামতগুলোকে বোধহয় বেদবাক্য ভেবে মুখস্থ করেছেন–
কি রকম? সোজা কথা কাগজ না পড়ে নিজের মাথায় যা আসে তাই ভাবার চেষ্টা করবেন।
কেন, কাগজপত্র তো ভালোই লিখছে–
ভালো মানে বেশ্যাবৃত্তি করে যাচ্ছে, যা আগেও করেছে। কে বেশি করে গায়ের কাপড় খুলে নিজেকে দিতে তৈরি, ভালো কাগজ বলতে এই-ই।
রাজীব ভাই বললে, তুমি অন্যদিকে যাচ্ছো। আমি যা বলছিলাম, বাইরে থেকে সামরিক শাসন যতো ভারি জগদ্দল পাথরই মনে হোক না কেন, তার ভিতরের সীমাহীন দুর্বলতার কথা এক ধাক্কায় জেনে গিয়েছে মানুষজন; বিচার করতে হবে এইভাবে–
খোকা বললে, যারা এখানে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি খাটিয়েছে, কিংবা যারা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় বাজার হিশেবে পেতে চায় দেশটাকে, তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে। দেশের লোকটোক সব ফালতু কথা, তাদের কাউমাউ চিল্লাচিল্লিতে সত্যিই কিছু যায় আসে না, তা না হলে গোটা ব্যাপারটার সামনে এভাবে অনিশ্চয়তা ঝুলে থাকতো না–
তারাই-বা কি করবে–রাজীব ভাই বললে, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এতোদিন সুবিধাবাদীদের ম্যাজিক দেখতে দেখতে দেশের লোক কুঁজো বাকা-বোবা-হাবা-কালা হয়ে গেছে; তা না হলে বৃটিশ সিংহকে খেদাবার পরও নতুন করে আবার এই সাত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির দরকার হয়ে পড়বে কেন?
মুক্তিটুক্তির কথা যে বলছেন, এ সম্পর্কে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা আছে, কোনো প্রোগ্রাম আছে? অর্থনৈতিক মুক্তি ছেলের হাতের মোয়া নয়। লেখাকথা আর কি, বোবা-ব্যাকা-হাবা-কালা বেড়েদের ঐক্য আবার ঐক্য!