মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে তাকিয়ে থাকে; তার দুচোখ নির্লজ্জতার সম্মোহনে আত্মহারা হয়।
প্রতিটি আঙুল যেন নিস্তব্ধতার এক একটি ঠোঁট, মনে হয় একদিন এদের ভাষা ছিলো; প্রতিটি নখ যেন এক একটি মিজরাব, অসংখ্য অদৃশ্য তারে বিলোল আলস্যে মৃদু মৃদু সুর তুলে চলেছে, নৈরাকার স্মৃতির মতো অবিরল শিথিল অবসাদে এক একটি দিব্য মূৰ্ছনা অর্ঘ্য হয়ে ঝরে পড়ছে নাস্তিগর্ভে।
খোকার চোখ তার অতল মুগ্ধ সরোবরে অলৌকিক রাজহংসীদ্বয়কে এইভাবে অবগাহন করায়; তৃপ্ত হয়।
রৌদের তেজ বাড়ছে বাইরে, আকাশের দিকে তাকালে চোখ ঝা-ঝা করে। জানালার পর্দা গোটানো ছিলো, টেনে দিতে গিয়েও কি মনে করে আবার ফিরে আসে খোকা; বসে সিগ্রেট ধরায়।
কেমন ভদ্রলোক আপনি, অফার করবেন না?
প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে খোকা বললে, চলে নাকি আপনার?
কখনো-সখনো, তবে নেশা নেই। ভালোই লাগে–আলতোভাবে আঙুলের ফাঁকে সিগ্রেট ধরিয়ে লুলু চৌধুরী বললে, আমার কোনো প্রিজুডিস নেই–
এবার চায়ের কথা বলি বরং–
আমি ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা বিয়ারের কথা বলবেন! আঁচল সামলাতে সামলাতে চটুল ভঙ্গিতে লুলু চৌধুরী বললে, এক্কেবারে রসকষ নেই আপনার।
খোকা বললে, ঘরে আমার একটি গার্জেন আছে, মেনে চলতে হয়। ওকে। ওসব জিনিশ ঘরে তুলতে দেখলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়বে। আপনার কিন্তু বিয়ার ছোঁয়া উচিত–
চামদড়ি হয়ে থাকতে বলেন নাকি, চর্বির কথা বলছেন তো?
তাই—
নিজের দিকে অগোছালো দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে লুলু চৌধুরী কৌতুক করে বললে, ছিটেফোঁটা মেদ থাকা তো ভালোই; আমারটা কি খুবই দৃষ্টিকটু?
এমন মুশকিল আপনাকে নিয়ে—
মুশকিল কিসের, সত্যিকথা বলতে আপনার এতো সঙ্কোচ কেন? এরপর আপনার হাতের জন্যে দু সেট রেশমি চুড়ি আনার কথা ভাবতে–
এর চেয়ে বেশি হলে আপনি আড়াল হয়ে যাবেন—
এ্যাশট্রের উপর ঝুঁকে আধপোড়া সিগ্রেট গুঁজে দেয়ার সময় লুলু চৌধুরীর স্খলিত আঁচল মেঝের কার্পেটে ঝরে পড়লো।
একফালি আঁটো চোলির কারাযন্ত্রণায় গুমরানো স্তনদ্বয়কে ভীষণ দুঃখিত মনে হয় খোকার! অসাধারণ লজ্জায় নিদারুণ বিস্মৃতির ভিতর জগতের এই একমাত্র উজ্জ্বল দুঃখে অঞ্জলি পূর্ণ করে চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
এবার উঠা যাক—
উঠবেন?
অনেক বোর করলাম আপনাকে!
অনেক—
আমি কিন্তু আবার আসছি।
পায়ে পায়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেল খোকা। বললে, একটু পরে আমাকেও বেরুতে হবে, আসুন তাহলে–
ফিরে এসে ঝটপট স্নানাহার সেরে ফেললে খোকা। একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আয়েশ করে বিশ্রাম নিলো কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে পড়লো মতিঝিলের উদ্দেশ্যে।
রঞ্জু বারান্দায় তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো, খোকা রিকশা থেকে নেমেই হাত দেখালো, ইশারা করলো চলে আসার।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে উঠতে হলো দোতলায়, সেজখালা ডাকলো তাকে।
খোকা বললে, দেরি করতে পারবো না!
সেজখালা বললে, কি চিন্তা করলি, যাচ্ছিস তোরা?
খোকা বললে, রঞ্জুকে বলেছিলাম, বলছে যাবে না–
আর তুই?
বাড়ি দেখবে কে?
সেজখালা অসন্তুষ্ট হয়ে বললে, কি জানি, তোরা কি বুঝেছিস তোরাই জানিস। প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, আর তোরা বাড়ি বাড়ি করে অস্থির হয়ে উঠেছিস। বাড়িঘরদোর যেন আর কারো নেই। মারামারি বেধে গেলে তাল সামলাতে পারবি?
খোকা বললে, শুনছি তো সব মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে–
সেজখালা বললে, সেতো আমরাও শুনছি, কিন্তু মানুষজনের শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোও তাই বলে বন্ধ নেই। না আছে। মাথার উপর কেউ, না আছে কোনো কাণ্ডজ্ঞান, শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারলে হয়–
খোকা বিরস কণ্ঠে বলল, এতোসব লম্ফঝম্প সেকি শুধু শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোর জন্যে, কিছু আসে না আমার মাথায়!
বুঝি না বাপ, শুনছি তো হুডদাঙ্গা হবেই–
সেজখালা আড়াল হতেই বেলী এসে দাঁড়ায়। তার চোখের কোলে কালি, দুশ্চিন্তাকাতর মনে হয় খোকার।
কবে তোর রাগ পড়ে?
খোকা বললে, কোনোদিনই না—
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো বেলী, রঞ্জুকে দেখে সে থেমে গেল।
রঞ্জু বললে, যাবি তো তৈরি হয়ে নে—
বেলীর মুখ ম্লান। সে বললে, আজ থাক!
তখন যে বললি যাবি?
ইচ্ছে করছে না আর এখন–
রংবাজি!
রঞ্জুকে নিয়ে এক সময় বেরিয়ে পড়লো খোকা, রিকশা ধরলো সেগুনবাগিচার।
সেই পুরানো গো রঞ্জুর, কিছুতেই যাবে না সে, কিন্তু কোনো ওজর আপত্তিই শুনবে না খোকা, সে বললে, বড় অবাধ্য তুই!
তাই বলে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হবে?
এক-আধদিন এ রকম হয়ে যায়—
রাজীব ভাই দুদিন যাবৎ বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। খোকাকে দেখে খুশি হয়ে বললে, এ-কদিন কোথায় ছিলে খোকা সাহেব, হাতা গুটিয়ে সংগ্রামে নেমে পড়েছো বুঝি?
নিজের সঙ্গে সংগ্রাম–খোকা বললে।
আমার মতো!
আপনারাও তাই চলছে নাকি?
চলছে তো বটেই, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না; বল পাচ্ছি না দেহে, মাথা ভার হয়ে আছে, নাক-কান বুজে শুধু বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে। করে।
নীলাভাবী বললে, শরীর ঠিকই আছে, চিন্তায় চিন্তায় অমন হয়েছে। ওনার। দিনকাল খারাপ, ঐ সাত রাজার ধন নিয়ে বাইরে যাবেই-বা কিভাবে, বুঝলে না?
তুমি তো বলবেই—
বলবো না কেন, কথাটা কি মিথ্যে? কবে তোমার শরীর খারাপ করেছে শুনি? দুডিগ্রি জ্বর নিয়েও তো বাইরে দৌড়ও, পাগলের ছাঁট আছে মাথায়!
একেবারে পাগল হতে পারলে তো ভালোই ছিলো, আধা আধা কোনো কিছুই ভালো না, খোকা কি বলো?
নীলাভাবী রঞ্জুকে নিয়ে অন্য ঘরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজীব ভাই কালিপড়া রুগ্ন চোখ তুলে জিগ্যেস করলে, কি রকম বুঝছো সবকিছু?