খোকা বললে, আমি কিছু শুনি নি, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই!
কেন, বাইরে তো যথেষ্ট কাগজপত্র ছেড়েছি আমরা। বুঝলেন না, এই হচ্ছে প্রকৃত সময়। সব টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হোক এখন আর বাঙালিদের কেউ তা চায় না।
হেড অফিসগুলো সব পশ্চিমে। দেখতেই তো পাচ্ছেন, দেশের লোক কিভাবে ক্ষেপে উঠেছে, সকলেই চাচ্ছে দেশের টাকা দেশেই থাকুক, দেশেই খাটুক—
বাধা দিয়ে খোকা বললে, সকলেই চাচ্ছে, না আপনারা তাদের জ্ঞানদান করছেন?
লুলু চৌধুরী হেসে বললে, দেশের লোকই চাচ্ছে–
খোকা আবার বাধা দিলো। বললে, দেশের লোক যে কি চায় তারা। নিজেরাই তা জানে না; হাত তুলতে বললে সবাই হাত তোলে, ঐ পর্যন্তই!
লুলু চৌধুরী অসহিষ্ণু হয়ে বললে, আপনি ঠিক ধরতে পারেন নি ব্যাপারটা। দেশে রাজনৈতিক দল রয়ে গেছে, মান্যিগন্যি নেতারা আছেন, তাঁরা তাঁদের নিজেদের কিংবা দলের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের লোককে যেদিকে ঠেলে দেবেন, তারা সেইদিকেই যাবে, কিছুই করার নেই আপনার-আমার। আমাদের কাজ হবে শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টটাকে মূলধন করে সময়মতো কাজে লাগানো, আমাদের ভূমিকা তো এই-ই!
এক মিনিট, চা না কোল্ড ড্রিংক?
না, চা নয়—
উঠে ফ্রিজ থেকে কোকাকোলা বের করলে সে, তারপর গ্লাসে ঢেলে লুলু চৌধুরীর সামনে দিলো।
খোকা বললে, তার মানে দেশের লোককে চুষে ছিবড়ে করে ফেলে দেওয়াটাই সব প্রোগ্রামের মূল কথা
যেমন?
শুধু বীমা কোম্পানির কথা ভাবছেন কেন, সকলেই যে যার স্বার্থে আদাজল খেয়ে ঐ সেন্টিমেন্টকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে, ফলটা কি দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত?
লুলু চৌধুরী বললে, আপনি কিন্তু পলিটিক্যালি চিন্তা করছেন!
খোকা বললে, যাকগে যাক, খামোকা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। আসল কথা আমার মতো অপদার্থকে দিয়ে আপনাদের কোনো লাভই হবে না!
দু একদিনের ভিতরই বাজারে শেয়ার ছাড়া হচ্ছে–
খোকার মনে পড়লো মুরাদের কবিতা সঙ্কলনের কথা। সে হেসে বললে, ভালো সময়ই বেছে নিয়েছেন আপনারা
লুলু চৌধুরী বললে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আপনি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন সবকিছু, কিছু শেয়ার কেনার জন্যেও তৈরি থাকুন।
কোনো উত্তর দিলো না খোকা, এটা এমনই একটি বিষয় যা নিয়ে কথা বাড়ানোর আগ্রহ তার বিন্দুমাত্র ছিলো না!
এছাড়াও লুলু চৌধুরীর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে অপ্রিয় দ্বিধাদ্বন্দ্বের ফেরে পড়েছিলো। লুলু চৌধুরীর এই হামলে পড়া উৎসাহের গায়ে যে রঙের আবরণই থাকুক না কেন, খোকা সেটাকে সহজভাবে নিতে পারে না। সন্দিগ্ধচিত্তে কেবল সে নিজের বিচার বিবেচনাকে তলব করতে থাকে!
লিখছেন নাকি কিছু? হঠাৎ জিগ্যেস করলে লুলু চৌধুরী। খোকার মনে হলো লুলু চৌধুরীর গলার স্বর জর্জেটের আঁচলের চেয়েও স্নিগ্ধ মধুর, কিন্তু পিছলে পড়া।
কে বললে আপনাকে আমি লিখি?
এক সময় আপনি লিখতেন, মুরাদের মুখে শুনেছি, দেখলেও বোঝা যায়। আপনার চেহারা কবির–
খোকা বললে, মুশকিলে ফেললেন। আমার তো ধারণা ছিলো খুন করার পরই মানুষের চেহারা খুনির হয়, তার আগে নয়। কবিদের মধ্যে আপনি কাকে কাকে দেখেছেন?
খুব প্যাঁচালো মানুষ আপনি–
আপনার ধারণা ভুল। এক সময় মাথায় গুবরেপোকা ঢুকেছিলো ঠিকই, ঐ পর্যন্তই; সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না, আপনার কোম্পানির ঐ কাজের মতোই–
বৈরাগী হয়ে যাবেন নাকি শেষ পর্যন্ত?
চাইলেও হতে দেবেন আপনারা!
তার মানে, আপনি আমার বন্ধু হচ্ছেন?
সে তো এখনোও।
মনে হচ্ছে না আমার—
খোকা হেসে বললে, আপনার একদম ধৈর্য নেই!
লুলু চৌধুরী বললে, আপনি বোধহয় মেয়েদের খুব ঘেন্না করেন?
মেয়েদের ঘেন্না করা যায়?
কেন যাবে না, এটা মনের ব্যাপার, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার; এ রোগে তো অনেকেই ভোগে–
আমার এ রোগের বালাই নেই। গোটা নারীজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম–
মানে আপনার কাছে তারা ঠাট্টার বস্তু!
সেটা নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ধরে নিতে পারেন এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, যাকে বলে কোরা, অশিক্ষিত—
আশ্চর্য কথা! অথচ আপনার চেহারা একজন প্রেমিকের–
খোকা বুঝলো কয়েকটি অলীক শাখা-প্রশাখায় ভিজে বাতাসের ছাপটা লাগছে, শিউরে উঠছে বর্শাফলকের মতো তীক্ষ্ণ কিছু পাতা। ফলে কোমল মূৰ্ছা তার যাবতীয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে কিছুক্ষণের জন্যে বিবশ করে দেয়।
সে হেসে বললে, গালমন্দের একটা নিজস্ব ভাষা আছে আপনার!
লুলু চৌধুরী বললে, তবু যাহোক একটা কিছু খুঁজে পেলেন শেষ পর্যন্ত, আমার আসাটা সার্থক হলো।
সবচেয়ে মুশকিল আপনাদের মতো ধ্যানী মানুষজনকে নিয়ে; ভাঁজ খুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়তে হয়।
ধ্যানী বলতে কি বোঝাচ্ছেন?
সত্যি কথা বলবো? বড় বড় চোখে তাকায়
বলবেন না কেন!
যারা শুধু অপচয় করে নিজেদের, জীবনভর–
তার মানে আপনার অভিধানে মূর্খরাই ধ্যানী। আপনার সঙ্গে আমি একমত; এই একটা ব্যাপারেই কখনো কোনো কিছু জানার দরকার হয় না।
কিছুটা দোমনা মনে হলো লুলু চৌধুরীকে এক সময়। কোলের উপরে ফেলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আনমনা হয়ে যাচ্ছে এক একবার।
লুলু চৌধুরীর দুটি পা এতোক্ষণে চোখে পড়ে খোকার, কি ধবধবে নিটোল ও মসৃণ! মনে হয় প্রতিদিন পা দুটি দুধে ভেজানো থাকে; এখনো লেগে আছে সর।
দেহের যাবতীয় কোমলতা গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের পাতায় এসে জমেছে; নীলঝর্ণার কোলে একজোড়া অলৌকিক রাজহংসী যে যার নিজের শুভ্রতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন।