ঘুমিয়ে পড়েছিস?
না।
ঘুম আসছে তো?
না।
আমারও ঘুম আসছে না। বসবি কিছুক্ষণ বারান্দায়?
উঠছি—
ভিতরের বারান্দায় বসলো দুজনে। জ্যোছনার ঢল নেমেছে আজ। খুব কাছাকাছি কোথাও একটানা ডেকে চলেছে একটি পাখি।
মাঝে না সিগ্রেট কমিয়ে দিয়েছিলি?
কেন?
এতো সিগ্রেট টানছিস কেন আজ?
কি জানি—
তুই না বলিস, বেশি সিগ্রেট খেলে ঘুম হয় না?
মনে করিয়ে দিবি তো!
আমি জানি—
কি জানিস?
তোর মন খারাপ?
কই? নিজের মুখ তো আর দেখতে পাচ্ছি না!
তোরও তো মন খারাপ!
বললেই হলো—
অতো চোটপাট করলে কে তখন?
সে তো তুই—
পান্তয়াটি! কাটমোল্লা বলে গাল দিস নি?
খোকার একটা হাত ধরে আবার ছেড়ে দিয়ে বললে, কই দেখা তো কোথায় ফোস্কা পড়েছে!
খোকা বললে, তুই যদি আর কোনোদিন আমার সঙ্গে মুখ কালো করে কথা বলিস, তাহলে তার ফল খুব ভালো হবে না, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু ভাগোয়াট হয়ে যাবো।
দিন দিন তোর আবদার বেড়ে যাচ্ছে।
আর তুই বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস—
বুড়ি তো হবোই, তোর মতো?
তুই বুড়ি হতে পারবি না।
খোকা সিগ্রেটের প্যাকেটে হাত দিতেই রঞ্জু কেড়ে নিলো, বললে, খবরদার আর একটাও ধরাতে পারবি না
খোকা বললে, তোর এতো মাথাব্যথা কিসের? আমার দিকে তোর খেয়াল আছে কোনো?
কে দ্যাখে তবে?
বেলী যে আমার ঘর অমন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল, তুই কিছু বলতে পারিস নি? উচিত ছিলো না বলা?
ওর ভালো লেগেছে ও করেছে, আমি বাধা দেবো কেন?
ইচ্ছে করলে তুই ওকে লজ্জা দিতে পারতিস।
মানুষকে কাঁদাতে খুব ভালো লাগে, না?
আমি বুঝি সবাইকে কাঁদাচ্ছি?
তবে কে?
তুই একটা মিথুক!
তোর মতো কেউ এমন নিষ্ঠুর নয়। আমাকে একা বাড়িতে ফেলে সারাদিন ড্যাংড্যাং করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানোর সময় কোনো কিছু মনে থাকে না তোর। যা ভয় লাগে! এই গণ্ডগোলের সময় এতোবড় বাড়িতে একা থাকা যায়, না?
ঠিক আছে, কাল থেকে দেখিস, পায়ে এক্কেবারে তালাচাবি। যদি কোথাও যাই তোকেও নিয়ে যাবো পোঁটলা বেঁধে, যাবি তো?
সকাল পর্যন্ত মনে থাকলে হয়।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ খোকা বললে, আচ্ছা এমন যদি হতো, আমরা চিরকাল ঠিক এখনকার মতোই ছোট থেকে গেলাম, কি হতো তাহলে?
ভালোই হতো—
তোর ইচ্ছে করে?
করেই তো!
সত্যি বলছিস?
না মিথ্যে বলছি, হলো তো!
আচ্ছা ধর, আমি যদি হঠাৎ মরে যাই তোর কি রকম লাগবে, খুব কাঁদবি না? ভেবে দ্যাখ ঝগড়া করার মতো তোর আর কেউ নেই তখন–
আমার খুব মজা হবে বুঝলাম–
মজাই তো! ছাদে বেড়াবো, ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাসবো, প্রেমপত্র লিখবো, বিছানা এলোমেলো করে দেবো, যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবো
ইচ্ছে হলে এখনো তা করতে পারিস!
পারি-ই তো! আমি কি তোর ভয় করি?
আমি বুঝি তাই বলেছি?
ওনার ভয়ে আমার ঘুম হচ্ছে না কিনা—
রেগে যাচ্ছিস কেন, তোকে নিয়ে এক মুশকিলই হয়েছে!
নিজে সাধুপুরুষ–
এই বুড়ি, ও কি রে হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে রঞ্জুর একটা হাত ধরে খোকা বললে, চোখে পানি কেন, কাঁদছিস বুঝি? এই পাগলি কাঁদছিস কেন, কান্নার কি আছে–
কোনো উত্তর দিলো না রঞ্জু, কেবল একটু জোরে সে ফুপিয়ে উঠলো। ওর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে খোকা বললে, কি তাজ্জব কথা, হলো কি তোর? কথায় কথায় ভেঁপু–
মরার কথা তোলার সময় খেয়াল থাকে না!
তাই বুঝি, এর জন্যে এতো ঝড়-বৃষ্টি? আগে তো এ রকম ছিলি না? তুই দেখছি পাগল না করে ছাড়বি না!
কেন তুলবি তুই ওসব বাজে কথা?
ভুল হয়েছে বাবা, মাফ করে দে—
কি অন্যায় করেছি আমি, যে তুই ওসব অলক্ষুণে কথা তুলবি!
আরে বাবা বললেই তো আর কেউ মরে না, মরা কি অতো সহজ!
কি জানিস তুই, কখন কোন কথা লেগে যায়, কখন কোন্ কথা সত্যি হয়ে যায়!
ঠিক আছে, আর কখনো বলবো না, কথা দিচ্ছি!
ভেজা চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো রঞ্জু। বললে, সব জিনিশ নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করবি না কিন্তু–
আবার? মাথা খারাপ তোর!
বুক আলগা কর–
খোকার পরনে ছিলো পাঞ্জাবি। দুটো বোতাম খুলে ফেললো সে। রঞ্জু থু থু থু করে তিনবার তার বুকে থুতু দিলো।
যাক বাবা, এ যাত্রা কোনোমতে টিকে গেলাম!
০৬. রঞ্জুকে মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে দিয়ে
রঞ্জুকে মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরে এলো খোকা; দুপুরের পর তাকে আবার যেতে হবে আনতে।
গেটের মুখেই দেখা লুলু চৌধুরীর সঙ্গে; ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না খোকা নিজের চোখকে। তাকে না পেয়ে বিমর্ষ মুখে ফিরে যাচ্ছিলো লুলু চৌধুরী।
খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন না?
কিছুটা–ড্রইংরুমে বসালো খোকা লুলু চৌধুরীকে।
ময়ূরনীল জর্জেট শাড়ি লুলু চৌধুরীর পরনে। বসার সময় কোলের ওপর আঁচল ঝরে পড়ে। এস্ত হাতে কাঁধে আঁচল তুলে লুলু চৌধুরী বললে, কোনো অসুবিধে করলাম না তো?
নিরুৎসাহিত খোকা বললে, ঠিক তা নয়, তবে আপনাকে যার আপ্যায়ন করার কথা, আপাতত সে ঘরের বাইরে, আমার বোন রঞ্জুর কথা বলছি–
আপনি তো আছেন!
কিছু একটা বলতে হয় তাই বলা, এমন ভঙ্গিতে গা ছেড়ে খোকা জিগ্যেস করলে, মুরাদ ঘরে, না বেরিয়েছে?
এতোক্ষণ বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে। চিন্তা করলেন কিছু?
বুঝতে পারছি না!
বা রে, বেমালুম ভুলে বসে আছেন সব?
আপনি কি সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছেন ব্যাপারটাকে?
বেশ লোক তো আপনি!
অযথা সময় নষ্ট হবে আপনার, ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন।
আমার কাজই হলো সময় নষ্ট করা। রুটিন ধরে সময় নষ্ট করতে হয় আমাকে লুলু চৌধুরী বললে, আপনাকে ব্যাপারটা খুলে বলি, বাঘা বাঘা কর্তাব্যক্তিদের কয়েকজনকে নিয়ে আমরা একটা গ্রুপ কোম্পানির পেট চিরে বেরিয়ে আসছি খুব শিগগিরই, উদ্দেশ্য নতুন কোম্পানি খাড়া করা, হয়তো কিছু কিছু শুনেও থাকবেন–