না কি রঞ্জুই ওকে সাহস জুগিয়েছে?
সাহসের যে জোগানদার তার নিজেকেও সাহসী হতে হবে এমন কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। রঞ্জু নিজে কতটুকু সাহসী? সবকিছুই কি নিখুঁত একটা অভিনয়? দিনের পর দিন স্রেফ অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে রঞ্জু?
রঞ্জু একটা দারুণ সমস্যা, এতোদিনে হঠাৎ মনে হয় খোকার। মুরাদকে কি সে গোপনে গোপনে কোনো চিরকুট চালান করেছে? এমন। বুকের জোর পেল কোথা থেকে মুরাদ? রমনা রেস্তরাঁয় মুখের ওপর ফশ করে একটা চিঠি ছুড়ে মারলে তার কি দশা হতো? নিজের সঙ্গে যুদ্ধ। চলে খোকার।
শেষ পর্যন্ত খোকা সন্ধি করে। রঞ্জু রঞ্জুই; রঞ্জু যদি ছিটেফোঁটা অনুকম্পাও করতো, মুরাদকে, তাহলে নিজেকে ঢেকে রাখতো মুরাদ, অহঙ্কারের তাপে তার মনোবল অবলম্বন করতো ভিন্ন পথ; আকুলি বিকুলি করতে হতো না তাকে অমন। এটা একটা একপেশে ঘোড়ারোগ, আলোচাল দেখে যেমন ভেড়ার মুখ চুলকায়।
বেলীর কাণ্ডকারখানা দেখে কতোবার মুখ টিপে হেসেছে রঞ্জু। বিছানার উপর বিশ্রীভাবে শুয়ে থাকার জন্যে দুম করে একবার কিল। বসিয়েছিলো বেলীর পিঠে। বেলী জোর করে যখন তাকে সস্তা সিনেমার গল্প শোনায় সে তখন বেলীর অজান্তে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকে; ঝিঝিপোকার একটি ফিনফিনে ডানা, একফোঁটা বৃষ্টির ভারেও যা মচকে যায়।
রঞ্জুকে একবার জিগ্যেস করে দেখলে কি হয়?
উচিত হবে?
না, উচিত হবে না। ঘৃণায় কুঁচকে যাবে রঞ্জু। কদর্য চোখকে কি করে ঘণা করতে হয় সে তা জানে। সে জানে, সে কোনো কুড়ানো মেয়ে নয়। রাস্তার, ফ্যালনা ন্যাতাকডনি পাতাকডনি নয়: নোংরা এঁটো চোখে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে একথা শুনলে আতঙ্কে শিউরে উঠবে সে।
মুরাদের উচিত তার ওই যাত্রাদলের সস্তা স্বভাব বদলানো। স্পষ্ট বলে দিতে হবে ওকে। য়ুনিভার্সিটিতে থাকার সময় যে সব বদভ্যাস ছিলো এখনো কিছু কিছু তার থেকে গিয়েছে। ওর নজরটাই খারাপ। টিউটোরিয়্যালের চিন্তায় অন্যদের মাথার ঘিলুর ভিতর যখন কিলবিলে পোকার কামড়ানি চলছে ও তখন করিডোরের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণী পায়চারিতে মশগুল। পুরুষ্টু মেয়েদের দেখলেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। বলতো-ও মাঝে মাঝে, থর নামা দেখলে আলামিয়াকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে আমার, ভালো কাম যদি তার কিছু থেকে থাকে তাহলে এই সবই। এমনকি রাস্তাঘাটে ভারবাহী জন্তুর মতো স্বাস্থ্যভারানতা যুবতী দেখলে ও পাগলামি শুরু করে দেয়, নাল গড়ায় ওর নোলা দিয়ে। হঠাৎ রঞ্জু ওর মাথার ভিতরে ঢুকলো কি করে ভেবে পায় না খোকা; কে বলবে এটা তার পুরানো স্বভাবেরই একটি অপভ্রংশ নয়! স্বাধিকারপ্রমত্ত আজকের মানুষ কপচাবার সময় দিব্যি আবার বদলে যায়।
রঞ্জু কি?
একটা টিনটিনে ফড়িং। দেখে মাতলামি চাগিয়ে ওঠার মতো কিছুই নেই ওর শরীরে। আদর করে একটু জোরে চাপ দিলেই মুড়মুড়িয়ে ভেঙে যাবে ওর হাত। পায়ের তলায় সামান্য একটু কাকর ফুটলে এখনো চোখমুখ সাদা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এখনো কাঁটা বেছে পাতে তুলে না দিলে ইলিশ মাছ খেতে পারে! এতো পলকা এতো কোমল যে সামান্য একটি দূর্বাঘাসের ভারও তার জন্যে অনেক; এইভাবে তাকে তুলোয় মুড়ে রাখতে খোকার ভালো লাগে।
ক্ষয়রোগ তলে তলে কুরে খায়, তারপর আচমকা একদিন এক ঝলক রক্ত তুলে কেতন উড়িয়ে জাহির করে নিজেকে; বয়েসও একটা ক্ষয়রোগ। বকের ভিতর ফাঁকা হয়ে গেল খোকার; আর সেই আসবাবপত্রহীন ফাঁকা ঘরে আপন অসহায়তার নুলো হাতে পিটপিটে কুপির আলো দেয়ার জন্যেই হাই হুম হাম শব্দ করলো দুচারবার। তার যাবতীয় দুর্ভাবনার গায়ে আকুল তার পুঞ্জ পুঞ্জ আর্দ্রতা জমে : হয়তো আমার নিজের চোখে ধরা পড়ছে না, নিরন্তর সাধন করে দিচ্ছে এই চোখ আমাকে, তুমি কোনোদিন সত্য উচ্চারণে সফলকাম হবে না এবং যাতে সফলকাম না হও সেইমতো একজোড়া কড়ির চোখ হয়ে আজীবন আমি তোমাকে পাহারা দেবো।
মুরাদকে কি আমি হিংসা করবো, আমার চোখজোড়া ওর মতো সন্ধানী নয়। ও যা দেখতে পায় আমি তা দেখি না কেন! গাছের একটি ভিজে পাতায় চন্দ্রালোকে দ্যাখে মুরাদ, আমি দেখি উদ্যত ফণা, ফলে আছাড় খেয়ে পড়ি দুঃস্বপ্নে। রঞ্জু কি হঠাৎ বড় হয়ে গেল?
ঘুম এলো না কিছুতেই। উঠে পানি খেলো খোকা। সিগ্রেট ধরালো। বই খুলে চেষ্টা করলো মনোযোগ দেয়ার, কিন্তু সবাই বৃথা, শত চেষ্টা করে ও একটা পৃষ্ঠা ওল্টাতে পারলো না সে। কি হয় বই পড়ে, অপরিসীম শ্রান্তি ও অনমনীয় কাতরতায় একটু একটু করে সে নুয়ে পড়ে; সে জানে এমন একটি চিন্তাও নেই সম্পূর্ণত যা তার নিজস্ব, একেবারে নিজের বলতে যা আছে তা কেবল যন্ত্রণা। এই একটাই সম্পত্তি যা একান্ত ভাবেই তার নিজস্ব। প্রত্যেকটি মানুষের যন্ত্রণা যার যার নিজের মতো, কারো সঙ্গে কারো মিল নেই, এই একটিই সম্পত্তি যা কারো কাছ থেকে ধার নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
শেষে পায়ে পায়ে রঞ্জুর ঘরে ঢুকলো।
বনস্পতির ছায়ার মতো মনোরম সবুজ আঁধার হালকা পাতলা ছিমছাম রঞ্জুর এই একটিপ শরীরটুকুকে কোমলতায় আচ্ছন্ন। করে রেখেছে। মনে হয় রাশি রাশি পাতার ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে জ্যোছনার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন আলো, যেন লতাগুল্মের স্নিগ্ধ নিশ্বাস; রাত্রিরানীর স্খলিত বসনের একটি চিকন সোনালি সুতো। ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে খোকা।
তারপর এক সময় আলো জ্বেলে দেয় খুট করে।