ঝক্কি চুকেছে। নে এখন শুয়ে পড়।
খোকা নিজের ঘরে চলে এলো।
চারপাশে বইপত্র ছড়ানো। বিছানার চাদরও এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড। এখানে বই, ওখানে খাতা, ঘরে পা দিয়ে একটু অবাকই হলো খোকা। ভূতপ্রেতের দল ফাঁকা পেয়ে মনের সাধ মিটিয়ে একচোট নাচানাচি করে গিয়েছে ঘরময়। কেবল দলামোচড়া কতগুলো কাগজ ভাঁজ করে অযত্নে কাটগ্লাসের ভারি এ্যাশট্রেটা চাপা দিয়ে রাখা। একটির পিছনে লেখা কেন লেখো, কেনই-বা ধ্বংস করো, তুমি কি?
এক সময় বিছানার চাদর ঠিক করতে গিয়ে বালিশ সরাতেই চোখে পড়ে একটি চারভাজের কাগজ :
খুব শিগগির আমরা বাঞ্ছারামপুর যাচ্ছি। তুমি যাবে না? যদি না যাও, হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। দেখা কোরো, ভয় নেই। তোমার কথা সবসময় মনে হয়। বড় নিষ্ঠুর তুমি। পায়ে পড়ি দেখা কোরো। তোমাকে তো পারে নি, তাই তোমার একলা বিছানাটাকেই এলোমেলো তছনছ করে দিয়ে গেল বেলী।
বেড়ে লিখেছে ছুঁড়ি, বিড়বিড় করতে থাকে খোকা। একলা বিছানা, খাসা খাসা! ভিতরে ভিতরে একেবারে ঝুনো হয়ে গিয়েছে, শাঁস বলতে কিছু নেই, সব ফোঁপল হয়ে গিয়েছে, ফোঁপল ফোঁপল।
বুকের তলায় বালিশ খুঁজে বারবার উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো চিঠিটা। খোকা মনে মনে বলতে লাগলো, পেকে গিয়েছে, বোটার গোড়া পর্যন্ত পেকে গিয়েছে এ মেয়ে। কায়দাটা ভালোই রপ্ত করেছে, তোমাকে তো পারিনি রক্ষে করো, না, গুণ আছে ওর, ওর লাইনে ও ডিগ্রি নেবার মতোই; এইজন্যেই লতানো ঝুলপি ভোগলা। পায়জামা আর ধনুকমার্কারা ওর পিছনে কামড়ি খেয়ে লেগে থাকে। সত্যি, গুণ আছে ওর। প্রতিটি সুযোগকেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করে, একটাই ওর চিন্তা, একটাই ওর সাধনা, কি দারুণ অধ্যবসায়! ওর হবে!
কেন লেখো, কেনই-বা ধ্বংস করো, ভেবে দেখতে হবে, খোকা মনে মনে হাসলো। ভেবে দেখলেও, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসার মতো সহজ করে বলা কি কোনোদিন সম্ভব হবে!
একের পর এক সিগ্রেট পোড়াতে থাকে খোকা, শেষ পর্যন্ত ময়নাকে কেন্দ্র করে তার ক্ষোভ ডালপালা বাড়ায়; কি করে পারলো রঞ্জু এমন একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে!
খোকার বিশ্বাস, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির। কোনো গোপন অভিলাষ দ্বারা কি অজ্ঞাতসারে সে প্ররোচিত হয়েছে?
মুরাদের কথা মনে হলো খোকার। তার ধারণা মুরাদের মনোভাব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলো সে। প্রথম থেকেই আমতা আমতা করছিলো। কদিন থেকে একনাগাড়ে কিল খেয়ে কিল হজম করে চলেছে, এটা ওর স্বভাবই নয়। রঞ্জুর দিকে মুরাদের তাকানোর ভঙ্গিটাও কিছুটা কুৎসিত ধরনের। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদ, আর জোর করে চোখমুখে এমন একটা নিস্পৃহতা আনে যাতে মনে হয় নিদারণ বীতশ্রদ্ধ সে এখন। এ চালাকি সে ভালো করেই বোঝে, নিরাসক্তির ব্যাপারটা স্বভাবের, জোর করে কেউ নিরাসক্ত হতে পারে না। অতো লুকোচুরির কি আছে; বন্ধুর বোন থাকলেই তাকে গিলে খেতে হবে! একটা মফস্বলের স্ব ভাব, গ্রাম্যতা। অগ্রপশ্চাৎ কোনো বিবেচনা নেই, মেয়ে দেখলেই বনবন করে মাথা ঘুরে যায়, কি হাঘরে স্বভাব এদের। এই স্কুলরুচির আমড়া কাঠের চেঁকিগুলো বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে জানে না। হাত ধরে ঘরে নিয়ে এসেছো কি বিপদ, শুরু হয়ে গেল চুলবুলুনি, গাবাগাবি; লটকাও বন্ধুর বোনকে!
মুরাদের আহত মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো। ব্যথিত হয়েছে মুরাদ। কথা বলতে পারছিলো না, কেঁদে ফেলার উপক্রম হয়েছিলো বেচারার। গায়ে। পড়ে দুরমুশ করেছিলো সে, মুরাদ ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গিয়েছিলো; এ ধরনের আক্রমণের জন্যে তার কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছিলো না। অমন উদোম আলাপের পর তার আর কোনো পথই ছিলো না গোপন কথা ওগরানোর। সে ইচ্ছে করেই হাতে হ্যারিকেন দিয়েছে, এক অর্ধচন্দ্রেই একেবারে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে।
এক সময় খুব খারাপ লাগলো খোকার; নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করেছিলো সে, তার নিজের ব্যবহারও খুব একটা রুচিসম্মত নয়, মনে। হলো এইসব। সময় সময় এমন নিষ্ঠুর হয়ে যাই, খোকা শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো, মুরাদের সঙ্গে এই নির্দয় ব্যবহার বন্ধুত্বের অতি সাধারণ একটি দাবিকেও অস্বীকার করে যায়। কিন্তু কেন, সব ব্যাপারটা আগাগোড়া সুন্দরভাবে শেষ করে দেওয়াও তো এমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না! স্পষ্ট বললেই হতো, রঞ্জুর দিক থেকে সে তার চোখ ফিরিয়ে নিক। নিছক কষ্টের ভিতর পা বাড়িয়ে কি লাভ তার! সে ভুল বুঝেছে রঞ্জুকে। রঞ্জু ভিন্ন ধাতের মেয়ে, ওর নিজেকেই পস্তাতে হবে শেষ পর্যন্ত। সে তো জানেই তার স্পষ্টবক্তার সুনাম আছে; শুধু এই সুনামটুকুই তাকে ভাঙাতে হতো। কাটগোয়ারের মতো সে বেছে নিয়েছিলো উল্টো পথ।
স্নায়বিক উত্তেজনা খোকাকে এলোমেলো করে দিলো এক সময়। এ ধরনের অস্থিরতার সঙ্গে তার কখনো পরিচয় ঘটে নি; এমন এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে আজ, যেখানে তার সব দৃঢ়তা মোমের মতো নিঃশব্দে গলে গলে পড়ে। আক্রোশে ফেটে পড়ে খোকা, বন্ধুত্বের সহজ নিবিড় সম্পর্কের মাঝখানে বাতুল সমস্যা এনে রেষারেষির প্রয়োজনই-বা কি! গাঁউয়া, নিরেট গাঁউয়া এই মুরাদ; স্বেচছায় সবকিছু দূষিত আবর্জনাময় করে তুলতে সে মনে মনে বদ্ধপরিকর। বন্ধুত্ব আর ডাস্টবিনের ভিতর কোনো পার্থক্য নেই।
বুকের তলার বালিশটাকে দুমড়ে দেয় খোকা। রঞ্জুর মতো মেয়ের কথা ভেবে সবকিছু বাস্তবতার নির্মল আলোকে বিচার করে দেখা উচিত ছিলো মুরাদের। চার বছর যাবৎ দেখে আসছে মুরাদ রঞ্জুকে। এখনকার আর পাঁচটা ডুগডুগি বাজানো। মেয়েদের মতো বেলেল্লা নয় রঞ্জু, অনেক আগেই তার বোঝার কথা। নিছক একটা ঘরকুনো মেয়ে, খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সারাদিনের ভিতর একটিবারও যার রাস্তার দিকে চোখ মেলে তাকাবার প্রয়োজন হয় না। তার এই আড়ষ্টতার কথা, ঘরকুরোমির কথা, নিজের কুণ্ডলীর ভিতর অচৈতন্যথায় পড়ে থাকার কথা, খুব ভালো করেই জানে মুরাদ।