পাবদা!
পাবলো নেরুদা–গুড!
দুজনে একসঙ্গে খেলো। পরে একসময় রঞ্জু বললে, তুই একটা আজব মানুষ, এতোক্ষণ কিছুই নজরে পড়ে নি তোর, আশ্চর্য!
কেন কি হলো আবার?
দেখতে পাচ্ছিস না কিছু?
কি জানি বাবা—
ময়নাকে দেখছিস?
তাই বল! কি হলো আবার ময়নাটার? ঠিকই তো, এসে থেকে ওকে দেখি নি। ওর বাবা নিয়ে গেছে বুঝি?
রঞ্জু বললে, ওর বাবা বিকেলের দিকে এসেছিলো ওকে নিতে, কিন্তু পায় নি–
পায় নি মানে, কি আবোল-তাবোল বকছিস?
পায় নি মানে পায় নি! ইচেছমতো তেরিবেরি করে গেল, তুই থাকলে নির্ঘাত হাতাহাতি হয়ে যেতো তোর সঙ্গে। লোকটা এমন মুখফোড়!
তা না হয় হলো, কিন্তু ময়নার ব্যাপারটা কি?
ময়না চলে গেছে!
তোকে বলে গেছে?
হ্যাঁ!
কিন্তু এ রকম হঠাৎ চলে যাবার মানে কি? গেলই-বা কোথায়?
ময়না হাতেম আলীর সঙ্গে গেছে—
কি সর্বনাশ! তার মানে ইচ্ছে করেই গেছে। পেটে পেটে এতো বজ্জাতি মেনিমুখো ছোকরার! আগে থেকে জানতিস তুই?
না! আজকেই শুনলাম সব। হাতেম আলী ওকে বিয়ে করবে। যাবার সময় বলে গেছে, ওর কোনো দোষ নেই!
তুই যেতে দিলি কেন?
দেবো না-ই-বা কেন?
তুই জানিস হাতেম আলীর মনে কি আছে?
হাতেম আলী ওর কাছে অনেকদিন থেকে পয়সা জমায়, ওই জমা। পয়সা থেকে কানের দুলও গড়িয়ে দিয়েছে ভিতরে ভিতরে। তেমন। তাড়াহুড়ো ছিলো না ওদের, হুট করে ময়নার বাবা এই টানা-হাচড়া পাকালো বলে–
তবু আস্কারা দিয়ে তুই ভালো করিস নি—
ও বুঝি আমার বারণ শুনতো?
একশোবার শুনতো। দায়িত্ব আছে আমাদের। সব জেনেশুনেই একটা উটকো লোকের সঙ্গে যেতে দিয়ে তুই ভুল করেছিস!
ও আমাকে বলতে চায় নি। আবডালে বসে বসে কাঁদছিলো, ওর প্ল্যান ছিলো না-বলে পালানোর। শুধু আমার চাপে পড়ে সব স্বীকার করে ফেলেছে!
কিন্তু তোর কাজটা হয়েছে বোকার মতো, এদের আস্কারা দিতে নেই; কি থেকে কি দাঁড়ায় তুই কি জানবি! কোনো চালচুলো নেই, ঠিক-ঠিকানা নেই, হাতেম আলী যদি ওকে পথে বসিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত, তখন? সব চাপবে আমাদের কাঁধে। তোর উচিত ছিলো আমার সঙ্গে পরামর্শ করা, মতামত জানা।
রঞ্জু ক্ষিপ্ত হয়ে বললে, পাচ্ছি কোথায় তোকে? আমার বারণ শুনতে ওর বয়েই গেছে! ও নিজে যদি ভালো মনে করে থাকে আমাদেরই-বা অতো মাথাব্যথা কিসের!
খোকা রঞ্জুর মুখের দিকে তাকালো! একরোখা জেদি ভঙ্গিতে ও পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বললে, টাকা-পয়সা নিয়েছে?
হ্যাঁ, আমিই চুকিয়ে দিয়েছি, ওর আশি টাকা জমা ছিলো—
বিরসমখে গা-হাত-পা ছেড়ে দিয়ে খোকা বললে, তাহলে এই ব্যাপার।
রঞ্জু কোনো কথা বললো না, মাথার বিনুনি খুলে নতুন করে কষে বাঁধতে বাঁধতে কেবল এক পলকের জন্যে খোকার মুখের দিকে তাকালো।
খোকা বললে, মুখ আঁধার করে বসে আছিস কেন অমন?
তুই-ই-বা মিথ্যে মিথ্যে আমার কাঁধে দোষ চাপাচ্ছিস কেন!
দোষ দিলাম বুঝি?
তবে কি!
যাব্বাবা!
রঞ্জু বললে, তুই একটা কাটমোল্লা!
তুই বুঝি?
হাতেম আলীটা খুব সরল, ওর ভিতরে কোনো প্যাঁচঘোচ নেই, বলিস নি আগে? কি এমন দোষ হয় ময়নাকে যদি ও বিয়ে করে? ময়না তো ওকে ভালোবাসেই–
আরেব্বাপ, ভক্তি বেড়ে যাচ্ছে তোর ওপর। কি করে জানবো তুই। এতো বুঝিস?
বললাম তো, তুই একটা বুড়ো ভাম।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে খোকা বললে, তাহলে সবাই ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে–
রঞ্জু কোনো উত্তর দিলো না।
তোর কি খুব ভয় লাগছে, সেজখালাদের সঙ্গে যাবি?
না।
এখানে থেকেই-বা কি করবি? এখনই কেমন ভুতুড়ে ভূতুড়ে ঘুটঘুটে হয়ে গিয়েছে পাড়াটা, তুই বরং বেলীদের সঙ্গে চলেই যা। কোনোদিন বাঁশঝাড় এঁদো পানাপুকুর দেখিস নি, এসব দেখা হবে। কি যেন গ্রামটার নাম, বাঞ্ছারামপুর, তুই যদি মনে মনে কোনো কিছু যাচ ঞা করিস তা পূর্ণ হবে ওখানে।
দরকার হলে তুই যা না!
আবার খাঁউ! ওখানে গেলে কেউ তোকে গিলে খাবে না।
বাপির কথা খেয়াল নেই বুঝি?
সে–তো আমি আছিই। দুজনে মিলে তোর ওখানে হাজির হবো। ব্যাপারটা মন্দ হয় না কিন্তু। এমনিতেও তোর কিছুদিন একলা থাকা দরকার, তখন মর্ম বুঝবি—
রঞ্জু বললে, তুই বরং ওদের সঙ্গে যা, বেলীও খুব খুশি হবে।
তাই বল! এতোক্ষণে বুঝলাম তোর গররাজি হওয়ার কারণটা। তুই বুঝি বেলীকে খুব হিংসে করিস?
হিংসার কি আছে এতে? বেলীর চিন্তায় দিনরাত যেন আমার ঘুম হচ্ছে না?
ঘুম হচ্ছে না আমার—
বেলীকে দেখলে তো তাই মনে হয়।
ওর একটা দুস্তরমতো হাতেম আলী দরকার, বুঝলি না!
তোর মুখটা একটা নরদমা।
তোর মুখ একটা ফুলের বাগান।
একটু পরে খোকা বললে, বেলীটা নিছক ঝামেলা। আপদটাকে কেন যে বিদায়ের ব্যবস্থা করছে না বুঝি না। সেজখালার উচিত দড়াম করে ওটাকে বিয়ে দিয়ে পার করা। দাঁড়া, এবারে এলে আমি নিজেই তুলবো–
পাত্র দেখে দিতে পারবি?
সেটাও একটা কথা। গোল্লায় যাক! বেলীফেলী নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তোর কোনো লাভ নেই, ওর ইস্কুল আলাদা, কালিকলম বইশ্লেট আলাদা; ওর ব্যাপার তুই বুঝবি না।
রঞ্জু বললে, পাড়ার কতোগুলো ছেলে এসে আজ ঝামেলা বাধিয়েছিলো। আমাদের ছাদে ফ্ল্যাগ নেই, খুব চোটপাট করছিলো ছেলেরা, বলছিলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেবো–
যে যার নিজের ছাদে একটা ফ্ল্যাগ ওড়ালেই সব হয়ে গেল আর কি! কারা যে এইসব চ্যাংড়াদের বুদ্ধি জোগায়! কি বললি ওদের?
দশ টাকা দিয়ে একটা ফ্ল্যাগ কিনতে হলো ওদের কাছ থেকে। ছাদে উড়িয়ে দিয়েছে লেবু।