মুরাদ কোনো কথা বললে না। খোকার দিকে মোমের মতো অদ্ভুত এক থির দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে সে বসে আছে। এক অচেনা ব্যাধের সামনে; মুখ দেখে মনে হয় তার হাত-পা পড়ে গিয়েছে, নিজেই নিজের ভার রাখতে অক্ষম এখন।
কি বলবি বল?
আমি জানি, তোর শোনার ইচ্ছে নেই—
ঘণ্টা জানিস তুই!
ভালো লাগছে না কিছু, চল, ওঠা যাক, বেশ রাত হয়েছে। রঞ্জু তোর জন্যে দুশ্চিন্তা করবে।
জটিল ব্যবধান ক্রমশ দুস্তর হয় দুজনের মাঝখানে, সেখানে টেবিলের পিঠ, এ্যাসট্রে, চায়ের কাপ, সিগ্রেটের প্যাকেট, সবকিছুই অপসৃত! দুজনের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে একটি ঠাণ্ডাহিম তরোয়াল।
বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো খোকা। রিকশায় ওঠার আগে পর্যন্ত কোনো কথা বললো না মুরাদ। নিঃশব্দে হাঁটলো। খোকা একা হাত-পা নেড়ে অনর্গল কথা বলতে লাগলো। এমনভাবে হাত-পা নাড়ছিলো যে এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে এ কথাই ভাবতো, একটি পাগল অন্ধকারের সঙ্গে পিংপং খেলায় মেতে উঠেছে।
চলি দেখা হবে–রিকশায় উঠতে উঠতে মুরাদ বললে।
রিকশায় উঠলো খোকাও। ছাউনি নামিয়ে দিলো মাথার। চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঝিপোকার ঐকতান; রাত্রি হয়ে আছে বহুকাল আগে ডুবে যাওয়া টাইটানিক, এ্যাঞ্জেলফিশের ক্ষীণ নিশ্বাস তার গায় দাগ কাটতে পারে না। রঞ্জুকে ভালোবাসে মুরাদ, আর রঞ্জু, ভালোবাসার ভও বোঝে না বেচারি, নিজের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর হঠাৎ হোহো করে হেসে ফেললে খোকা, রাক্ষস!
০৫. ঘুম জড়ানো আধবোজা চোখ
ঘুম জড়ানো আধবোজা চোখ ডলতে ডলতে দরোজা খুলে দিলো লেবু।
ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে চিল্লাচিল্লি করছি, কানে তুলো এঁটেছিলি নাকি, অপদার্থ কোথাকার!
ঘরেই ঢুকেই লেবুকে একচোট ধমকালো খোকা। উত্তর না দিয়ে ঘাড় নিচু করে থাকলো লেবু। ঘরদোর সব ফাঁকা ফাঁকা, থমকানো, কিছু একটা ঘটেছে, উসখুস করতে থাকে খোকা।
আলো জ্বালালো খুট করে।
রঞ্জু, এই রঞ্জু!
কোনো উত্তর নেই।
রঞ্জু তুই খেয়েছিস?
আগের মতোই কোনো সাড়া না পেয়ে বিছানার দিকে এগোয় খোকা। খাটের উপর ঝুঁকে বললে, কি রে, ঘুমের ওষুধ গিলেছিস নাকি, এই
বোঝা গেল জেগে আছে সে। খোকার দিকে পিঠ দিয়ে পাশ ফিরে শুলো।
ঠ্যালা সামলাও এখন! কি রে, গোঁসাঘরে গিয়ে খিল দিয়েছিস নাকি? একবাটি তেল লাগবে?
এবারও কোনো উত্তর পেল না খোকা। এতে কিছুটা অবাকই হয় সে। সাধারণত এ ধরনের একগুঁয়েমি করে না রঞ্জু; গোঁ ধরে বসে থাকা কাকে বলে জানে না বললেই হয়, খোকা নিজেই বরং কিছুটা ঘাড়গোঁজা স্বভাবের।
এই আহ্লাদী!
পকেট থেকে চটকানো রুমাল বের করে রঞ্জুর মুখের ওপর ছুড়ে দিলো খোকা।
এই পান্তাকুড়ি, কি হয়েছে কি তোর? ওঠ না, বেশি আদিখ্যেতা করলে গায়ে পানি ঢেলে দেবো।
হঠাৎ মনে হলো খোকার দাঁতে দাতে চেপে ঢোক গিলে গিলে রঞ্জু কাঁদছে।
লেবু, একটা লগি নিয়ে আয়, ওকে আমপাড়া করবো–
শেষে বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছে গেল। হাত ধরে টেনে ঘুরিয়ে দিলো। সত্যিই গুমরে গুমরে কাঁদছে রঞ্জু।
খেয়েছে রে! এইনে, কানমলা খাচিছ, আর রাত করবো না কখনো, ঘাট মানছি, আচ্ছা ডাব্লু তো! বুদুর মতো কাঁদছিস কেন, এই বুড়ি!
খোকা ওর গালে হাত বুলিয়ে দিলো! চোখের পানিতে ভিজে গেল হাত। হেসে আঙুলের ডগা ভিজে চুঁইয়ে টকাশ করে একটা শব্দ তুলে সে বললে, না তেমন নোনতা নয়, ফিকে হয়ে এসেছে নুনটা; তার মানে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছিস। বালিশটাও ভিজিয়ে ফেলেছিস। বালিশে দানা লাগিয়েছিস নাকি, চারা তুলবি?
বালিশে চোখ-মুখ ডলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো রঞ্জু।
খোকা বললে, বুঝলাম, আমার চেয়ে দেয়ালটাই তোর কাছে ভালো এখন। ঠিক হ্যায়, এখন থেকে ওটাকেই দাদা বলে ডাকিস।
সিদ্ধেশ্বরী থেকে চাচা এসেছিলেন, সাড়ে নটা পর্যন্ত ছিলেন, জরুরি কথা আছে। কালকেই দেখা করতে বলেছেন–
গুলি মার!
বারবার বলেছেন, কালই যেতে; খুব চটে গিয়েছেন তোর ওপর। খুব চোটপাট করেছে তাহলে? আমরা বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবো কি না জানতে এসেছিলেন, সবাইকে দেশে পাঠাচ্ছেন। আমাদেরও যেতে বলছেন সঙ্গে!
যতোসব গুবলেটমার্কা কথা। বাড়ি ফেলে রেখে যাই, আর সবকিছু লুটপাট হয়ে যাক, ভালো করতে পারি না মন্দ করতে পারি, কি দিবি তা বল!
সেজখালাও এসেছিলেন–
বলিস কি! কতোক্ষণ ছিলো?
দুপুর থেকেই ছিলেন, সন্ধ্যার একটু আগেই চলে গেলেন। তুই যাসনে কেন?
বললো বুঝি?
কতো কান্নাকাটি করলেন। শিগগির কুমিল্লায় চলে যাচ্ছেন সবাই, শুধু সেজখালু থাকবেন। আমাদের যেতে বলেছেন ওঁদের সঙ্গে।
হুঁ। সঙ্গে নিশ্চয়ই বেলী ছিলো, না থেকে ভালোই হয়েছে, বেলীটা একেবারে অসহ্য আমার কাছে।
থেকে যেতে চেয়েছিলো, সেজখালা রাজি হলেন না, বললেন আমি একা একা ফিরতে পারবো না, অন্যদিন আসিস।
পরে শোনা যাবে সব, এখন ওঠ দেখি। হাবার মতো এ্যাঁয়ু এ্যাঁয়ু করে কাঁদছিলি কেন?
এমনিই। এমনিই আমার কেউ কাঁদে নাকি?
আমি এমনিই কাঁদি–
তার মানে তোর ট্রিটমেন্ট দরকার। তোর কানে গরম রসুন-তেল ঢালা দরকার; নির্ঘাত একটা ইস্কুরুপ ঢিলে হয়ে গিয়েছে তোর মাথার ভিতর। দেরি করে ফিরেছি বলে কাঁদছিলি?
বাপির জন্যে মন কেমন করছিলো।
এটা তোর বাড়াবাড়ি। তারিখ এসেছে যে হাপুস নয়নে কান্না। জুড়বি?
যদি না আসতে পারে?
যদি আবার কি এ্যাঁ? তোর যতো উড়ো বায়নাক্কা। খামোকা মন খারাপ করাটা ধাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেমে চল, দারণ খিদে পেয়েছে, পেট চুইচুই করছে। দুপুরের মাছ রেখেছিস তো, কি মাছ?