এসব ডাস্টবিনের কথা! বছরের পর বছর ওই একই গতে কথা বলে যাবি তোরা, তবু যাহোক ল্যাটিন আমেরিকার কথা ওঠেনি। তোর কথায় আজকের পৃথিবীর স্বাধিকারপ্রমত্ত মানুষের যে ছবিটা ফুটে উঠেছে তাতে তুড়িলাফ দেয়ার মতো তেমন কিছু নেই। খবরের কাগজের মাসমাইনের রিপোর্টার কিংবা পেশাদার ভাড়াটে নেতাদের মতোই দায়সারাগোছের একটা চেহারা আঁকলি তুই। আজকের পৃথিবীর মানুষ বলতে গিয়ে তুই কিছুসংখ্যক মানুষকে একফালি তরমুজের মতো আলাদা করে ফেলতে চাস। তার মানে গতকালকের পৃথিবীতে যে মানুষ ছিলো তাদের সঙ্গে এদের ঘোরতর প্রভেদ ধরতে পারছিস তুই। গতকালকের পৃথিবী সম্পর্কে তোর মনে নিশ্চয়ই কোনো স্বচ্ছ ধারণা জন্মেছে, তা না হলে ওই টনটনে ভেদজ্ঞানটা আসছে কোত্থেকে। এখন আমাকে বুঝিয়ে বল, গতকালকের সেই মানুষের সম্পর্কে তোর যাবতীয় ধারণার মূল সত্য কোটি, নাকি ওটা এমনিই কথার কথা?
তার মানে তুই আমাকে ভূতের ভয় দেখাবি এখন, এই তো? খচড়ামিটা তোর আজন্মকালের ঘোড়ারোগ। সব কথা বুঝেও না বোঝার ভান করে আমার কাঁধে গায়ের জোরে একটা মতো চাপাতে চাচ্ছিস
চোখের পলক পড়তে না পড়তে পাচশো টনের একটা কোবাল্ট বম গোটা পৃথিবীকে হিরোশিমা করে ছাড়তে পারে বলে মানুষকে আমরা আজকের মানুষ হিসেবে যেমন চিহ্ন দিতে পারি না, ঠিক তেমনি রাশিয়ার নিপীড়িত জনগণ জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেছে বলে তাদেরও আমরা আজকের মূর্তিমান মানুষ বলে আখ্যা দেবো না। এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই রমনা রেস্তরাঁয় বসে যাকে আজ বলে আখ্যায়িত করছি, আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তা গতকাল হয়ে যাবে। গতকাল আজ আগামীকাল এগুলোর ঠুনকো আপেক্ষিকতাকে তুই নিশ্চয়ই স্বীকার করিস। কিন্তু মানুষ, যখন আকাশে তারার অভ্যুদয় ঘটেনি তখনকারও এক সভ্যতার কথা আমরা শুনে থাকি, টিটিকাকা হ্রদের কোলে টিয়াহুয়ানাকোর সভ্যতা এই ধরনের প্রাচীন। গতকালকের মানুষ আর আজকের মানুষ বলে কোনো কথা নেই। টিয়াহুয়ানাকোর মানুষও যা, থাটমোসের মিশরীয়রাও তাই। কখনো সিজারকে সে হাতের স্টাইলাসে কুপোকাত করছে, কখনো সিংহের চামড়া পরে যোদ্ধার বেশে বাদর নাচ নাচছে মোজাম্বিকে। প্রত্যেকেই মানুষ। দলাক্রোয়াও মানুষ ছিলো, শাগালও মানুষ, রশিদ চৌধুরীও মানুষ। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা বিনয় মজুমদারের সঙ্গে বংগো বাজানো প্রাদোর আমি কোনো তফাত দেখি না। লা-হোলা লেখা মোপাসার সঙ্গে একজন ভুডো এক্সপার্টের আদতেই কোনো প্রভেদ নেই। সবক্ষেত্রেই ওই একই কথা, মানুষ। পাঁচশো টনের কোবাল্ট বম ঝাড়তে পারিস বলে, কিংবা লংমার্চ করতে পারিস বলে তুই মুরাদ চৌধুরী কিংবা শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী আজকের মানুষ হতে পারিস না। মানুষ পিরামিড গড়েছিলো, মানুষ কলোশিয়াম নির্মাণ করেছিলো, বাগদাদের ইলেকট্রিক ব্যাটারির কথা শুনিসনি!
এখন দয়া করে কিছুক্ষণের জন্যে তোর ওই ব্যাপারটাকে তুলে রাখ, এসব ফালতু কথা ঘাঁটাঘাঁটির কোনো মনে হয় না। তাই ঘরের দরোজা বন্ধ করে ভুডো প্রাকটিস কর, আমাকে ওর ভিতর জড়াসনে। তোর লাইন আলাদা। তুই শালা ডাক্তারকে বলিস ম্যাজিশিয়ান, ভ্যালিয়মকে বলিস মাদুলি, অক্সিজেনকে বলিস ঝাড়ফুক। আমার স্পষ্ট মনে আছে এখনো গত বছর স্যালাইনকে অক্ষতযোনি ষোড়শীর টাটকা পেচ্ছাব বলায় হাসপাতালের ডাক্তাররা তেড়ে এসেছিলো তোকে মারতে।
কথাটা ঘুরিয়ে দিলি তো? ভালোই করেছিস—
এই রোবটের কথা শুনলেই আমার গা শিরশির করে। যে কথার জন্যে এসেছিলাম এখানে, তা আর বলা হবে না আজ।
কি বলতে চেয়েছিলি?
না আজ থাক। এখন আর ভালো লাগছে না। এখানে সে রকম পরিবেশ নেই। পচা নালী ঘা-র মতো থুথুক করছে, অন্য কোথাও বসা উচিত ছিলো আমাদের–
পরিবেশ-টরিবেশও আছে এর মধ্যে, ব্যাপার কি?
দোহাই তোর, জোর করিস না–অসহায় ভঙ্গিতে মুরাদ বললে, আজ আর কিছু ভালো লাগছে না!
তুই আমার রাত্রির ঘুম নষ্ট করছিস!
তোর তো রাত্রে ঘুমই হয় না—
খচড়ামি রেখে কি বলতে চেয়েছিলি বল, ভনিতার কি দরকার।
তুই আমাকে জোর করছিস, কিন্তু আমি জানি শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে। তবু তোকে বলা দরকার, সেই জন্যেই যেতে চাচ্ছিলাম তোর কাছে।
বুঝলাম তো, তারপর? খোকা বড় বড় চোখে মুরাদের দিকে তাকালো। অবসন্ন মনে হয় মুরাদকে; মানসিক শ্রান্তিতে একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে সে।
তোর মন খারাপ হয়ে যাবে খোকা, বরং শুনে কাজ নেই—
প্যানপ্যানানি রেখে খুলে বল যা বলার।
কথা দে, সব শুনে আমাকে ঘৃণা করবি না!
ব্যাপার কি, সিফিলিস নাকি?
কি যা-তা বলছিস!
সিফিলিস যা-তা ব্যাপার হলো? বোদলেয়রের ছিলো না?
আমি তো আর বোদলেয়র নই।
হতে কতোক্ষণ! এই যে এতো ভ্যারেন্ডা ভাজলাম তাতেও কি তুই বুঝতে পারিস নি যে বোদলেয়রের সঙ্গে আদতেই তোর কোনো তফাত নেই। আর এভাবে যদি দেখতে কষ্ট হয় তাহলে খোলা চোখেও মিল খুঁজে পাবি। এটা বরং তোর পক্ষে আরো সহজ। বোদলেয়র যা যা করতো তুই-ও তাই করিস। তুই কবিতা লিখিস, দুএকবার পাড়ায় গিয়েছিস, ড্রিংক করিস, অনুবাদেও হাত দিয়েছিস। বোদলেয়রের মতো তোর শুধু লেপ্টে থাকা ধুমসো ভেনাস নেই, যে তোকে ফতুর করে ছাড়বে। তা ওটা তুই নিজেই ম্যানেজ করে নিতে পারবি, সে গুণ তোর আছে। আজকাল তোর যে চালচলন দেখছি তাতে বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না ঐসব জিনিশ লটকাবার জন্যে দিনরাত হন্যের মতো ঘুরছিস তুই। চেহারাটাও মালখোর মালখোর টাইপের হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তা জুটিয়েছিস নাকি এক আধটা ঢাউস জিনিশ? তোর তো আবার গম্বুজমার্কা পেল্লায় পেল্লায় জিনিশের খায়েশ হয়; নৌকোর দুলুনিতে গা গোলায়, চিরকালই তুই ইস্টিমারে চাপা পছন্দ করিস। কিবে, হুব্বার মতো জিভ কামড়ে বসে আছিস কেন, মাল ছাড়! মাল ছাড়!