খোকা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যাতে একটি সিগ্রেটের পুরোটাই আঙুলের ফাঁকে নিঃশব্দে পুড়ে যায়।
আমিও একটা স্বপ্ন স্বস্তিকা, ক্রশ আর সুলেমানের তারকার মতো আমিও একটা স্বপ্ন; খোকার মনে হয়, সুরক্ষিত অতীত আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝখানে ঝুলন্ত এক সেতুর উপর কুটকুটে ন্যাতাজড়ানো ফ্যানা ছেলের মতো সর্বক্ষণ কি খেলায় যে বিভোর!
মুরাদ তুই লা হোলা পড়েছিস?
পড়িনি, কেন বলতো?
এমনি-ই! আমার ঘরে আছে, পড়ে দেখিস। আজ কদিন থেকে। মনের ভিতর কেবল লা-হোর্লা লা-হোলা চলছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!
মাঝে মাঝে এমন সব উদ্ভট কথা বলিস!
তোর ধারণাটাই বোধহয় ঠিক, ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটবে এবার!
ধানঝাড়া করবে, এই আর কি! মুরাদ হেসে বললে।
আরো অনেক বেশি। হয়তো আমরা কেউই থাকবো না; স্বপ্ন হয়ে যাবো–
মুরাদ অকারণে হাসতে লাগলো। বললে, তুই কোনটা চাস? সাত কোটি লোক মারা যাক, শুধু আমরা কয়েকজন বেঁচে থাকি, না আমরা এই কজন শুধু মারা যাই, সাত কোটি লোক অক্ষত এবং জীবিত থাকুক, কোনটা?
মুরাদ একটু থেমে কিছু একটা ভাবলো। একটা সিগ্রেট ধরালো। বললে, আর একটা ইন্দোনেশিয়া হতে চলেছে দেশটা–
তোর একটা গুণ আছে মুরাদ, সবকিছু তুই খুব সহজভাবে নিতে পারিস। ভিতরে ভিতরে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে যাচ্ছে–
গুণটুন বুঝি না–চটাস করে সিগ্রেটের ছাই ঝেড়ে মুরাদ বললে, গতানুগতিকতাকে আমি ঘৃণা করি! পরিবর্তন চাই। এমন একটা পরিবর্তন যা সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে, বদলে দেবে। মানুষ আর স্রোতের শ্যাওলায় কোনো তফাত নেই এখন, এটা ঘূণ্য। শিরদাঁড়াকে এমনভাবে বেঁকিয়ে রেখেছি যা লাথি না খেলে কখনো সোজা হবে না। মার চাই আমাদের, শয়তানের মার।
তার মানে সাপের মতো খোলস বদল করে আমরাও বারবার নতুন হতে চাই।
সাপের মতো কি না জানি না–মুখ অপেক্ষাকৃত শক্ত করে মুরাদ বললে, তবে পরিবর্তন আমরা চাই, আর এই জন্যেই আমরা মানুষ। পরিবর্তন থেকে পরিবর্ধন। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নিত্যনতুন চিন্তা করার একটা ঐতিহ্য রয়ে গিয়েছে বাঙালিদের; আমরা এই তুচ্ছ হেলাফেলার জিনিস নই!
পরিবর্তন আর রূপান্তরের তফাত বুঝিস?
কি রকম? চোখ কোঁচকালো মুরাদ।
গ্রেগর স্যামসা রূপান্তরিত হয়েছিলো পোকায়–
তার মানে পরিবর্তনমান সমাজের মানুষরা তোর কাছে সন্দেহের পাত্র। গদি আঁকড়ে থাকা ক্ষমতালোভীদের মতোই নিছক মাছ ধরার জন্যে পানি ঘোলা করছিস তুই। কতোগুলো বাতিক আছে তোর, দুঃস্বপ্নের নরকে হাবুডুবু খাওয়ার অভ্যেসটা মজ্জাগত দোষ হয়ে। দাঁড়িয়েছে।
তুই শুধু চোখ দিয়ে দেখছিস কেন সবকিছু—
তুই দেখছিস কান দিয়ে–
খোকা অসহিষ্ণু হয়ে বললে, তোর কি কখনো এইসব দুমদুমারি হট্টগোল দেখে অন্য কোনো কথা মনে আসে না? ওদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা তাহলে রইলো কোথায়? তফাতটুকু কি তাহলে এইটুকুই–ওদের গায়ে খাকি পোশাক আমাদের গায়ে গামছা, ওদের পায়ে বুটজুতো আমাদের পায়ে চটি, ওদের কাঁধে অটোম্যাটিক রাইফেল আমাদের কাঁধে ইশলের বই! তফাতটা যদি কেবল এইটুকু হয়, তার মানে এও দাঁড়ায়, প্রয়োজন হলে আমরা খাকি পোশাক পরবো, রাইফেল কাঁধে নেবো। কিন্তু খুব ভালো করে খতিয়ে দেখলে ধরা যাবে ওরা যা, আসলে আমরা তা নই। ওরা যা পারে আমরা তা পারি না। আমাদের তা পারা উচিত নয়। আমি পাঞ্জাবি সোলজারদের মতো হতে ভালোবাসি–এই জাতীয় কথা উঠলেও ঘূণায় শিউরে উঠবো আমরা। কিন্তু কেন? গুণ্ডামি পাণ্ডামি লুট হত্যা ধর্ষণের জাতীয় চরিত্র নেই বলে? ঠিক তা নয়; হয়তো উল্টোটা বলেই। আমরা মানুষ, হৃদয়হীন, চিন্তাশক্তিহীন রোবট নই; তুই আমার কথা শুনছিস?
শুনছি! মুরাদ মাথা নেড়ে বললে, আমরা যে কি মাল প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই তা বলে দেবে–
খোকা মুরাদের কথা ধার দিয়েও গেল না।
সে বললে, আমরা কি বলি? বলি পশুশক্তি! ওরা এক একটা জানোয়ার। আধা জানোয়ার থেকে এক লাফে পুরোপুরি জানোয়ার হওয়াটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, বরং সেটাই সহজ। আমরা এই আধা জানোয়ারের দল সবসময় পুরোপুরি জানোয়ার হয়ে ওঠার জন্যে উদগ্রীব থাকি, প্যাঁচপেচে পরিবেশ দলদলে পরিস্থিতি এসব খুঁজি, সুযোগ পেলেই গর্জন করে জাহির করতে চাই সেই পশুত্বকে। কিন্তু আমি বলছি ওরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে এক একটি রোবট, নিছক পশু নয়। প্রয়োজনের খাতিরে আধা জানোয়ার থেকে পুরোপুরি জানোয়ার হতে পারি, কিন্তু বল, রোবট হতে পারবি, চিন্তা করতে পারিস তুই?
বরং তুই থাম খোকা। এখনই আমার গা ছমছম করছে। গ্লাসে ঢেলে যা গেলা যায়, তোর অভ্যেস মড়ার মাথার খুলিতে ঢেলে তা গেলা। তুই শালা বুজিংগো দলের পাণ্ডা; এক কাপ চাকে ইচ্ছে করে হেমলক বানিয়ে ফেলিস!
আমি কি খুব বাজে কথা বলছি?
প্যাঁচ মারাটা তোর চিরকেলে স্বভাব। আন্দোলন ইজ আন্দোলন–খুব জোর দিয়ে মুরাদ বললে, রোবট আবার কি? আগেও বহুবার তুলেছিস কথাটা, আধুনিক মানুষ তোর কাছে নিছক রোবট।
বাধা দিয়ে খোকা বললে, রবার্টসনের টিটানের কথা তোর মনে আছে? তুই কি মনে করিস নিছক সাইন্স ফিকশন? তাহলে টাইটানিকটা কি?
মুরাদ বললে, এখানে যা কিছু ঘটছে, কিংবা ঘটতে চলেছে, সেটা অভাবনীয় কিছু নয়, ইতিহাসের নিয়মেই তা হচ্ছে। বুজরুকি মেরে ধাপ্পা দিয়ে জনতার রুদ্ররোষকে ধামাচাপা দেওয়া এখন অসম্ভব। আজকের পৃথিবীর স্বাধিকার প্রমত্ত বলবান মানুষ তার দৃষ্টিকে আর আচ্ছন্ন রাখতে চায় না; তারা সদা সতর্ক। স্বাধিকারকে যা খর্ব করবে, নস্যাৎ করে দেবে, এমন সবকিছুর ওপরই তারা আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর!