বয়েস কতো হলো রঞ্জুর? গালে রেজর টানতে টানতে হিসেব করে খোকা, সাত বছরের ছোট রঞ্জু। আরো দুটি বোন ছিলো রঞ্জু আর তার মাঝখানে, একজন অঞ্জু অপরজন মঞ্জু। বাঞ্ছারামপুরে মামা বাড়ির পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের শ্যাওলায় পা হড়কে পানিতে পড়ে যায় অঞ্জ, মঞ্জু নামে তাকে ধরতে; বাঁচানো যায় নি দুজনের একজনকেও। রঞ্জু যেন মামাবাড়ি সেই আশ্চর্য শান্ত তিরতিরে পুকুর যার গভীর গোপন তলদেশে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে অঞ্জু আর মঞ্জু।
দাড়ি কামানো শেষ করে গোসলখানায় গেল খোকা; একটানা চারদিন বিরতির পর শরীর জুড়ানো দীর্ঘ গোসল চাই।
০২. ধানমণ্ডির একটা বড় রাস্তা
ধানমণ্ডির একটা বড় রাস্তার কোল ঘেঁষে খোকাদের বাড়ি। মোহাম্মদপুরগামী বাসে ঈদগা অথবা মধুবাজার স্টপেজে নামলেই কয়েক পা হেঁটে তাদের বাড়িতে পৌঁছানো যায়।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নিজেদের বাড়ির গাড়ি বারান্দার ছাদে হুমড়ি খেয়ে পড়া বোগেনভিলিয়ার খুনখারাবি দেখতে পায় খোকা। ইউলিসিসের সমুদ্রগামী জাহাজ, মাস্তুলের মতো খাড়া ইউক্যালিপটাস গাছটা দেখে তাই মনে হয় এখন। কাতানের ফুরফুরে পাঞ্জাবি আর ধবধবে পায়জামায় ফিটফাট বাবুটি সেজে বেবিট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সবকিছু কেমন নির্ভার মনে হলো খোকার।
আজ চারদিন পর ঘর থেকে বের হয়েছে সে। হয়তো বহু কিছুই ঘটে গিয়েছে সারাদেশে। রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছে, তার ওপর চতুর্দিকে হাজার রকমের ডামাডোল। জাহাজ বোঝাই সৈন্য চট্টগ্রামের দিকে ছুটে আসছে, বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের ওপর বোমা দাগানো কসাই টিক্কা খান আসছে নতুন লাট-বাহাদুর হয়ে; দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, ছবি, তবু এসবের কোনো গুরুত্ব খোকার কাছে নেই। রাজনীতির ব্যাপারটাই আগাপস্তলা একটা জমকালো ছেনালি; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলে নি। রাজনীতির ব্যাপারটা তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাশের মতো।
কিন্তু যাওয়া যায় এখন কোন্ দিকে? কাজের অছিলায় তো বের হওয়া গেল, খোকা লক্ষ্য স্থির করতে করতে ভাবলো…আপদ আর কি, ভরা দুপুর এখন, রেক্সে গেলে একটা আডডা চলতে পারে, আডডা চলতে পারে গোপীবাগে ইয়াসিনের ওখানে। ইছাপুরায় তার কলেজ বন্ধ থাকায়। দেদার মিটিং শুনে বেড়াচ্ছে ছোকরা; কথা বলার মানুষ পেলে ভরদুপুরে একটা হিল্লে হবে ওর। আর যাওয়া যায় রাজীব ভাইয়ের ওখানে, অবশ্য রাজীব ভাইকে এই সময় পাওয়া দুষ্কর; কুমিরের চামড়ার একটি ব্যাগ বগলদাবা করে রাজীব ভাই নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে। আর কেউ না থাকুক নীলাভাবী আছে; শোরগোলের পর আর ওদিকে যাওয়াই হয় নি খোকার।
মুরাদের ওখানে গেলে কি হয়! মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে তারপর ইয়াসিনের ওখানে ঢু মারা চলে।
খোকা স্পষ্ট বুঝতে পারে এই মুহূর্তে নীলাভাবীর দখলে চলে গিয়েছে। সে, হাত-পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই তার। সত্যি, আশ্চর্যের কথা, নীলাভাবীর জন্যে আজকাল আর অকারণে তার মন আকুল হয় না; যেন অভাবনীয় একটি বই, প্রথম কয়েকটি পাতা পড়ার পরই দুর্মদ কৌতূহল সামলাতে না পেরে অধৈর্য পাঠকের মতো সে শেষটা পড়ে ফেলেছে।
অনেকদিন পর নতুন করে খোকার আবার মনে হলো কারো জন্যে মন খারাপ করার এই বিশ্রী ব্যাপারটা না থাকলে দুনিয়াটা সত্যিই একেবারে ফিকে পানসে হয়ে যেত, এই এখন যেমন রঞ্জুর জন্যে তার ভারি খারাপ লাগছে। সে যখন বের হয় তখন মুখ আঁধার ছিলো রঞ্জুর।
না, রেক্সে যাওয়া চলবে না। ইদানীং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র, আইনগত কাঠামো, চীনের চাবি ভুট্টোর খেল-তামাশা, এইসব নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে ওখানে। আর আহামরি এক লেখক পেয়েছে গোরভিদাল, তাই নিয়েও কতো মতবিনিময়ের ছড়াছড়ি; এক একটা নিরেট মাল সব। বরং নীলাভাবী অনেক ভালো। কথার প্যাঁচে ফেলে একে অপরকে অহেতুক হেনস্তা করার কোনো অপপ্রয়াসই নেই ওখানে। আড্ডা আর তর্কের মুখোশ এঁটে বন্ধুরা যখন মাঝে মাঝে হীন মনোবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে একে অপরের। নামে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, জারিজুরি ফাঁসের ব্যাপারে পরস্পর নোংরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার মন বিশ্রীরকম তেতো হয়ে যায়। নীলাভাবীর ওখানে আর যাই হোক এইসব কদর্য ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয় না তাকে; কখনো কুঁজো বামন অস্কারের মতো টিন ড্রাম বাজায় না কেউ, বরং ঘুমের ভিতর বালকের পেচ্ছাবের মতো অলক্ষ্যে সময় কেটে যায়।
শোরগোল,–হ্যাঁ, একটা শোরগোল ক্রমশ জোরালো হয়ে অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে বাতাসে। খোকা কান পাতলো, দ্রুত ফুসে উঠছে হৈহল্লা, একটা মিছিল রায়ের বাজারের দিক থেকে ক্রুদ্ধ অজগরের মতো এঁকেবেঁকে সদর রাস্তায় উঠে ই.পি.আর-এর দিকে এগিয়ে চলেছে; কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে ঢাকা শহর, কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষ, কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে লোহার রড, কালো পতাকা, বর্শা, তরোয়াল, বৈঠা, কোদাল, শাবল, কাঁধে নিয়েছে যে যা পেরেছে। কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট, বদলে যাচ্ছে মুখের আদল, দ্রুত দ্রুত, দ্রুত এবং ধাবমান, গ্লেসিয়ারের মতো ধাবমান; দুর্মদ মৃত্যুর মতো দরগলমান গ্লেসিয়ার। মানুষ! মানুষ! মানুষ আর মানুষ! আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়, কারা অলক্ষ্যে পথ মাড়ায়… গা ছমছম করতে থাকে খোকার। কবিতার একটি পুরোনো পঙক্তি, অথচ আজ কেন যেন সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো, একটা অভূতপূর্ব অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চের ঝাপটা লাগলো তার সর্বাঙ্গে। বাঁধভাঙা বন্যার তুমুল জলস্রোতের মতো অবিরাম অবিশ্রান্ত মানুষ; শস্যক্ষেত খামার উইঢিবি বাশঝাড় সাকো শহর-বন্দর গণিকালয় সবকিছু সেই অপ্রতিরোধ্য জলরাশির বিমর্দিত তোড়ের মুখে অকাতরে ভেসে চলেছে। এ কোন নূহের প্লাবন, ভিতরে ভিতরে খোকা টাল খায়, তার মাথা দপদপ করে।