ইয়াসিন বললে, আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। যার মুখে যা শুনছি, তাই বলছি–
খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে মুরাদকে জিগ্যেস করলে, ধর সব দাবি যদি মেনে নেয়?
নিতেই পারে না–জোর দিয়ে মুরাদ বললে, বললাম না, সব ঘটনার মুখ একই দিকে! এতোদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তোর কি মনে হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো হিশেবী বুদ্ধি ওদের মাথায় ছিটেফোঁটাও আছে? রাজনীতি নামে এতোদিন প্রাসাদের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের মগজে যা ছিলো তাও গাবিয়ে ফেলেছে; দেশীয় কুইসলিংরাও চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। আমি বলে রাখলাম, তুই দেখে নিস, সব শালার পতন হবে, কোনো শালা টিকবে না। এ হলো বর্ণমালার ইন্দ্রজাল। আয়ুব খান থেকে এর শুরু, আমরা যাকে বলি সামরিক শাসন, কখনো নির্বাচনের মুখোশ এঁটে, কখনো গামছা ফেলে একেবারে বাবা আদমের মতো ন্যাংটো হয়ে। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এ থেকে যে ভূতুড়ে যজ্ঞের শুরু তা ওয়াই-তে এসে ঠেকেছে, এরপর জেড, চীনা জুতার সুখতলা জুলফিকার আলী, ব্যাস, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, এই-ই গানের বই গানের বই!
খোকা কোনো কথা বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ঘনায়মান। অন্ধকারের দিকে।
পানির উপরে হাওয়ার নাচন শুরু হয়েছে। বাংলা কবিতার একটি বিড়াল অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুকিয়ে আনছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর চল নামি আষাঢ় আসিয়াছে ধরনের ঝাঁপ দিয়ে উদ্যানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি করে নৃত্যরত জিপসী তা কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন শিলকুড়নি শৈশব। শৈশব জীবনে বারবার আসে
কেন? আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার। এই এক অদ্ভুত জীবন, ধাপে ধাপে এরা নিজেদের ছোট করে তোলে, রক্তে মিশে আছে। এদের নিজেদের পতন।
ইয়াসিনও এক সময় উঠে দাঁড়ালো। বললে, মধ্যে থেকে আমার বিয়েটা পিছিয়ে গেল, গুলি মারি শালার আন্দোলনে। দেশের লোক আর সময় পেলো না ম্যান্ডেট দেয়ার, চলি!
এইসব ভূত যেন কখনো আমার কাঁধে ভর না করে, খোকা ভবিষ্যতের প্লীস্থ গাড়তে থাকে মনে মনে; ভিতরে যে ভুড়ভুড়ে পাক আর গরল জমে আছে খোকার ইচ্ছে নয় তা ঘাঁটাঘাঁটি করার। মিস্ট্রেস রাখলে কেমন হয়। জা পল সার্ত আর সাইমন দ্য ব্যভেয়ার আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু ফরাসি মেজাজ তো আর আমানি খেয়ে খেত চষে আর পাট জাগ দিয়ে ধার পাওয়া সম্ভব নয়, আমরা সবাই এক একটা ভোদড়, ভুসিমাল, একুশে ফেব্রুয়ারি ভেঙে খাচ্ছি এখনো; গোটা দেশ কলের লাঙল দিয়ে চষে বেড়ালেও একজন বিদগ্ধ মানুষ খুঁজে বের করা যাবে না, হুব্বা, গেঁড়ে, সবকটা দিকপালই এক একটা আনকুথ, এক একটা গাঁইগুঁই, গুফি!
দ্য এসিয়েৎ এর বৈদগ্ধ চাই, চোখ চাই এনস্ট-এর। ফাঁক পেলেই ঝি চাকরানীকে পটাপট বিয়ে করে ফেলা মেজাজ আমাদের। বড় বড় পাট্টিতে সুটবুটওয়ালারা ট্যারা চোখে ঘ্যাঁসঘাস করে পাছা চুলকায় আর শব্দ করে ঢেকুর তোলে এখনো। নাজ সিনেমায় খেলে যাওয়া রঙিন মলাটের বই কিনে বাঁশের বক কক্সবাজারি ঝিনুক, শামুক আর প্লাস্টিকের খেলনার সঙ্গে সাজিয়ে রাখে ড্রইংরুমে ঘটা করে। গোটা দেশের মানুষজনই এক একটা ভুসিমাল, যে যার লাইনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের পাউডার মুছছে আর পিচ পিচ করে পানের পিক ফেলছে, গুফি! গুফি!
মুরাদ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে নীরবে। ভালো লাগে না খোকার। তার চোখ একটা পলকা প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায়, গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, স্বপ্নের গর্ভকেশরে :
সবকিছুই একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের ভিতরে আমরা জন্মাই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা চিৎকার করে উঠি, ঝনঝন ভেঙে যায় সব কাচ, তির তির করে কেঁপে ওঠে দুধের সর, কৌমার্যের পাতলা পর্দা। স্বপ্নের ভিতরে আমরা স্তন্যপান করি, স্বপ্নের ভিতরে আমরা শিল কুড়াই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, স্বপ্নের ভিতরে অঞ্জু পুকুরে পড়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে মঞ্জু তাকে ধরতে যায়, স্বপ্নের ভিতরে নীলাভাবী কাচের চুড়ির শোকেস হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে রাজীব ভাই বৈদুর্য-বিদ্রম হাতড়ায়, স্বপ্নের ভিতরে ফিয়াট বড় হয়ে ওড়ে, স্বপ্নের ভিতরে বেলী ব্লাউস ছিড়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতরে লিপস্টিক জড় হয়, স্বপ্নের ভিতরে লুলু চৌধুরী কান ধরে টানে, স্বপ্নের ভিতরে মোদিল্লিয়ানী রঙ ছুড়ে দেয়, স্বপ্নের ভিতরে অর্ধেন্দু মুখ পুড়িয়ে ফেলে, স্বপ্নের ভিতরে মতিয়ুর শালিক হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে প্রীতি বিষ গলায় ঢালে, স্বপ্নের ভিতর হাইপোস্টাইল হল ভেঙে পড়ে, স্বপ্নের ভিতর পার্থেনন গমগম করে বাজে, স্বপ্নের ভিতরে পাপ পুণ্য হয়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে আত্তিলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার হড়াম করে ওঠে, স্বপ্নের ভিতরে দেখতে দেখতে আমরা আরেক স্বপ্ন হয়ে যাই।
এইসব মনে হয় খোকার।
কাচের একটি বিশাল স্বচ্ছ গোলাকার চিমনির ভিতর মাছির মতো বারবার পিনপিন করে ঘুরতে থাকে এইসব স্বপ্ন।
খুব কাছে, লেকের কোল ঘেঁসে কয়েকটি সাদা রাজহাঁস; খোকার মনে হয় স্বপ্ন। কালো বরফ, নীল চাঁদ, সবুজ সূর্য, রক্তবৃষ্টি, মাংসবৃষ্টি–এক একটি রাজহাঁস। স্তন, শিল, পুকুর, কাচের শোকেস, বিদ্রম, ছেঁড়া ব্লাউস, লিপস্টিক, বিষ, শালিক, হাইপোস্টাইল হল, সবকিছু রাজহাঁসের একটি পালক।