বললে হাত তোলে, স্লোগান দিতে বললে স্লোগান দেয়, আপার চেম্বার খালি আর কি!
মুরাদ গায়ে মাখলো না। সে বললে, রমনা রেস্তরাঁয় যাবি?
খোকা রাজি হলো।
গিশগিশ করছে রমনা রেস্তরাঁ। লেকের উপর ঝুলন্ত কাঠের পাটাতনে চেয়ার টেনে বসলো দুজন। মুখচেনা অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি এবং হাসি বিনিময় হলো খোকার; এক একজন এক একটা দল নিয়ে বসে আছে, ফোয়ারা ছুটছে যুক্তিতর্কের।
আডড়া শেষ করে উঠে যাচ্ছিলো প্রভাত গঞ্জালেস ও ইয়াসিন। খোকার দিকে চোখ পড়ায় ফিরে এলো আবার।
ইয়াসিন বললে, থাকিস কোথায়, দেখাই পাওয়া যায় না!
খোকা বললে, ইছাপুরায় ফিরে যাসনি এখনো?
আর ইছাপুরা। মানুষজন ঢাকা ছেড়ে সব গ্রামাঞ্চলে ভাগছে আর আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়, দেখি বরাতে কি জোটে!
সব লীলাখেলা তো এখন ঢাকায়–মুরাদ বললে, গোটা দুনিয়ার চোখ এখন ঢাকার দিকে; বিশ পকেটওলা নীলপ্যান্টে পথঘাট থৈথৈ!
গঞ্জালেস একটা হাই তুলে জড় ভাঙলো। বললে, সেই দুপুর থেকে এখানে, মেরুদণ্ড টনটন করছে, আর ভালো লাগছে না–
তার একটা হাত ধরে টেনে বসালো ইয়াসিন। বললে, আরে বোস বোস, তুইই এখন একমাত্র ভরসা সকলের; যাবো তো আমিও!
কথাটা মন্দ বলিসনি–মুরাদ বললে, পালানোর দরকার হলে তোর ওখানে গিয়ে উঠবো; কলাকোপা-বান্দুরা জায়গাটাও মন্দ নয়!
গঞ্জালেস বললে, কে যে কাকে জায়গা দেবে এখন এখানে বসে। সেকথা তোলা মুশকিল, মাথায় কাপড় তুলে আমাদেরই যে একদিকে ছুটতে হবে না এ কথা জোর দিয়ে কারো পক্ষে বলা অসম্ভব। ভিতরের খবর খুবই খারাপ।
খোকা বললে, তোর তো আবার সব বিদেশিসূত্রের খবর। ভাগ্যিশ কনস্যুলেটে কেরানির চাকরিটা ছিলো, তা না হলে দেশের ভাগ্যে যে কি ঘটতো!
গঞ্জালেস বললে, অবস্থা খুবই কেরোসিন, ঠাট্টা নয়!
ইয়াসিন মনমরা হয়ে বললে, দেশের অবস্থা যে খারাপ দিকে যাচ্ছে তা বোঝার জন্যে তোর ওই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ছাদা করার দরকার নেই, এমনিই বোঝা যায়। ইশ, সারারাত কিভাবেই না কুকুর কাঁদে! আমার শালা ঘুমই আসে না, মনে হয় একটা মড়ক লাগবে—
মুরাদ বললে, কুকুর আমাদের ওদিকেও কাঁদে, কিন্তু এটা একটা রদ্দিমার্কা কুসংস্কার!
ইয়াসিন চটে উঠলো। বললে, এড়ো তর্ক করাটা তোর একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা দেখতে পাচ্ছি; নিছক নিজের কোট বজায় রাখার জন্যে গায়ের জোরে তুই কথা বলিস। কি করে জানলি এটা কুসংস্কার; অভিজ্ঞতা আছে তোর কোনো?
মুরাদ বললে, লেখাপড়া শিখে এদেশের মানুষের কোনোদিন কোনো উন্নতি হবে না, সব শালা পিছনে হাঁটা মানুষ, তোদের দেখলে তাই মনে হয় আমার–
ইয়াসিন ক্ষেপে উঠে বললে, কুকুরের কান্না সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই!
বললাম তো, অর্ধেক খনার বচন আর অর্ধেক পিথাগোরাস, তোরা হচ্ছিস এই মাল। দেশের কটা লোকে বিশ্বাস করে যে মানুষ চাঁদে গেছে? দাসত্বটা আমাদের চিরকেলে স্বভাব!
গঞ্জালেস উঠে দাঁড়ালো। বললে, আমি আর বসতে পারছি না, কিছু কাজ আছে, আবার দেখা হবে–
সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। রাত্রির রঙ এখনো ঘনীভূত হয় নি; ধূসর আচ্ছন্নতার গায়ে অনুলিপ্ত ঘন নীল, আকাশ আড়াল হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। খুব দূরে কোথায় রক্তাভ ধূম্রকুণ্ডলী হলহল করে ঊর্ধ্বমুখে ঠেলে উঠছে। আকাশের গায়ে আঁকা একটা খেপলা জালের মতো ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ছে; ভূগর্ভের কোনো এক প্রেতায়িত ধূম্রাগারের খোল ফেটে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছে, কখনো-বা একটা স্তম্ভ, আকাশকে যা নিদারুণভাবে বিদ্ধ করবে। খোকার চোখের সামনে পার্থেনন তৈরি হয়।
কোথাও আগুন জ্বলছে–খুব আচ্ছন্নভাবে বললে ইয়াসিন।
কোনদিকে মনে হয়?
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
চতুর্দিকে নীল অন্ধকার মসলিনের ফিনফিনে যবনিকার মতো নড়ছে, দুলে দুলে উঠছে। দীর্ঘ বনস্পতি আর অবগুণ্ঠিত কুঞ্জবনের ক্ষীণ নিশ্বাসের পালকে নিজেকে সাজিয়ে এক নির্ভার জিপসী ঘাঘরা দুলিয়ে যেন উদ্যানময় নৃত্য করে ফিরছে। পানির ছাদে ব্যাঙের লাফ, ঝিঝিপোকার ঐকতান, সামান্য কয়েকটি খুচরো শব্দেই অর্থময় হয়ে উঠছে সন্ধ্যা; মনোরম যবনিকা সরে গেলেই রহস্যময় ছায়ানৃত্যের জিপসী তার কাঁধ থেকে দড়াম করে কাঠের এই পাটাতনে একটি ছাগশিশু ছুড়ে দেবে, ভিতরে ভিতরে এইসব অনুভূতি সিঁদ কাটে।
আমি হাঁপিয়ে উঠছি মুরাদ, আর ভালো লাগছে না—
তোর তো মাঝে মাঝেই এ রকম হয়। বলতে পারিস কখন তোর ভালো লাগে?
ঠিক সে রকম নয়, মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো!
দূরের ওই আগুনটা দেখেই বোধহয় এরকম মনে হচ্ছে তোর। আমার এসব কোনো প্রতিক্রিয়াই হয় না–মুরাদ বললে, যা অনিবার্য তা ঘটবেই, তোর আমার যতই বুক ঢিপঢিপ করুক!
ইয়াসিন কিছু একটা ভেবে ঘড়ঘড়ে গলায় বললে, বন্দুকের দোকানগুলো সব লুট হলো, জেল ভেঙে কয়েদিরা সব ভাগতে শুরু করছে, এখানে আগুন ওখানে আগুন, লুটপাট। মোটেই ভালো লক্ষণ না এসব!
ওই তো বললাম, সব ঘটনার মুখ একই দিকে, ভালোভাবে যাচাই করে দেখলেই বুঝতে পারবি।
খোকা গা ছেড়ে দিয়ে বললে, আমার একেবারেই ভালো লাগছে না, তুই খুলে বল।
মুরাদের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে খোকা তাকে নিরিখ করে চলেছে, সে বুঝতে পারে। সতর্ক হলেও খোকার চোখের ভাষা এই মুহূর্তে তার কাছে জটিল কুহেলিকাচ্ছন্ন মনে হয়।
হিটলারের সেই রাইখস্ট্যাগ জ্বালিয়ে দেয়ার কথা মনে আছে, নিজেকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করার জন্যে এটা তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো সেদিন। একটু থেকে মুরাদ বললে, যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার সবকিছুর পিছনে একটা অদৃশ্য লোমশ হাত রয়েছে, যে হাতে মদ আর বারুদের গন্ধ। লুটপাট আর আগুন ঠেকাতে গিয়ে আমি কম লোকের মাথা ফাটতে দেখিনি। এখন এমন একজনও মানুষ পাবি না সে ছেলেই হোক বুড়োই হোক শ্রমিক হোক, যাই হোক না কেন, যে সজাগ নয়, সতর্ক নয়। তুই-ই বল না, এদেশের মানুষের এতো তাড়াতাড়ি আর এমন সর্বগ্রাসীভাবে আত্মােপলব্ধি ঘটবে তুই নিজেও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলি? এর আগে কখনো আমরা এমনভাবে একাত্মতা অনুভব করি নি। সারা দেশের মানুষ আশ্চর্যভাবে এক হয়ে গিয়েছে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একতার এই দুর্ভেদ্য দুর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার। ওরা সবসময় এমন সব বানোয়াট পরিস্থিতি তৈরি করতে সচেষ্ট থাকবে যা ওদের। আঘাত হানার জঘন্য ব্যাপারটাকে যৌক্তিক করে তুলতে সাহায্য করবে। একটা বছর ধরে এই যে সমানে ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া-সাবধান সাবধান এর স্রোত চলছে এটা যে নিছক একটা স্লোগান নয়, ওরা তা খুব ভালো করেই জানে। যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, এই আর কি; কেবল নিজেদের তৈরি করে নিতে যে সময়টুকু লাগে। সময় আর সুযোগ অনুকূলে এলেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।