খুবই বিরক্তিকর, তবু শুনতে হয় খোকাকে! সে চোখ কুঁচকে বললে, আপনি গ্রাহ্যের মধ্যে না আনলেই হয়
তাতো বটেই! তবু অনেক সময় এসব তেতো লাগে। হাজার হোক আমরা তো মানুষই!
খোকা বললে, আপনার এই শেষের কথাটি আপনার চাকরির জন্যে খুবই বেমানান, বিশেষ করে এতোক্ষণ যা যা বললেন, যেভাবে বললেন, তা যদি মানতে হয়–
এতোক্ষণ যা বলেছি সেটাই ঠিক–লুলু চৌধুরী জোরের সঙ্গেই বললে, আমি যদি সাতহাত ঘোমটা টেনে ঘরে বসে থাকি আপনাদের বন্ধুরা আমাকে মাসোহারা দেবে? তাহলে না হয় তাই করা যাবে, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি তাহলে–
খোকা বললে, জিগ্যেস করে দেখবো এক সময়।
তাই করবেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার–হাসতে লাগলো লুলু চৌধুরী।
আসল কথা আপনি একজন মেয়েমানুষ, এটাই শেষ পর্যন্ত বুঝলাম।
আপনার কি সন্দেহ ছিলো এতে?
খোকা বললে, তর্ক করে কোনো লাভ নেই, আপনি নিজেই জানেন, এসব কথা তুলে আপনি নিজেই হেরে গিয়েছেন।
কিছু একটা ভেবে, অল্পক্ষণ পরেই লুলু চৌধুরী বললে, আপনি তো কিছু করছেন না, চেষ্টা করছেন নাকি কোনোদিকে?
কই আর।
আসুন না আমার সাথে!
কি রকম?
আমাদের কোম্পানিতে আসুন—
এখনো সে রকম কিছু ভেবে দেখি নি!
আমি বলি কি, একটা এজেন্সি নিয়ে ফেলুন, আমার ধারণা আপনি ভালো করবেন।
খোকা হেসে বললে, ভালোই বলেছেন—
আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি!
তা-তো বুঝতেই পারছি, সব ব্যাপারেই আপনি সিরিয়াস!
আপনি চিন্তা করুন–নড়েচড়ে বসে লুলু চৌধুরী বললে, আমি আপনার ওখানে একদিন আসবো!
কিন্তু—
বাধা দিয়ে লুলু চৌধুরী বললে, কোনো কিন্তু নয়, আপনি মনে মনে তৈরি হয়ে থাকুন, বাকিটা আমি করে দেবো, আমার বিশ্বাস একটু উদ্যোগ নিলেই আপনাকে চালানো যাবে।
চল উঠবি নাকি? মুরাদ ঢুকলো এই সময়।
লুলু চৌধুরীও উঠে দাঁড়ালো। চোখমুখে প্রসন্নতার ছাপ। বিদায় নিয়ে টুপ করে বেরিয়ে এলো খোকা।
দুজনে হাঁটা শুরু করলো। চারপাশে মানুষজনের মেলা। অনেকের হাতেই লাঠি। মেয়েরাও হাতে লাঠি নিয়ে ঘোরাফেরা করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। হাবভাবে চালচলনে মনে হয় ওই জিনিশটা হাতে থাকলেও ওর গুরুত্ব সম্পর্কে ওদের তেমন কোনো ধারণা নেই। এই এখনো কয়েকটি মেয়ে লাঠি হাতে কলরব করতে করতে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বোঝা যায় সকলেই স্কুল-কলেজের মেয়ে। কিন্তু তবু, বেশ কিছুদিন যাবৎ রাস্তাঘাটে প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। মেয়েদের। ধীরে ধীরে মরে যাচেছ ঢাকা শহর। নিভে আসছে। কোনো কোনো অঞ্চল একেবারে খাখা, নীরব, সন্ধ্যার পর অকারণে গা ছমছম করে।
এতোক্ষণ জর্দা কিমাম দেওয়া খুব কোম্পানির খিলি খাওয়াচ্ছিলো নিশ্চয়ই? হঠাৎ জিগ্যেস করে মুরাদ।
ঠিক বুঝলাম না সবকিছু, ধোলাইটা বোধহয় আমার ওপর দিয়েই গেল!
অসম্ভব কিছু নয়। একচোট হয়ে গিয়েছে আমার সঙ্গে। ওকে যে বোঝাতে পারবে, সে এখনো মায়ের গর্ভে!
দারুণ ভড়কে গিয়েছিলাম, যাই বলিস, প্রথমে তো বুক ঢিপ ঢিপ করছিলো–
একটা দেশলাইয়ের কাঠি দাঁতে খোঁচাতে খোঁচাতে মুরাদ বললে, ওসব ভয় নেই। সাধারণত ও খারাপ ব্যবহার করে না, বাইরের কেউ হলে তো নয়ই। এটা ও যেমন করেই হোক রক্ষা করে চলবেই। হিশেব করে কথা বলার মতো ক্ষমতাও ওর আছে, ভালোমতো মিশলে তুইও বুঝতে পারবি।
তুই নিশ্চয়ই আমার নাম তুলেছিস, এটা উচিত হয় নি তোর!
কিছুই যায় আসে না ওতে। ওর গুডবুকে না হয় নামটাই কাটা যাবে তোর, তাতে আর কি! শুনলি না কিভাবে কথা বললে? কখনো খুলে মেলে জোর গলায় অভিযোগ তুলবে না ও, বিচার চাইবে না; এমনভাবে কথা বলবে যেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের মতামতগুলোকেই নিছক যাচাই করে নিচ্ছে। ও জানতো যে-কোনো মুহূর্তে আমি এসে তুলে নিয়ে যাবো তোকে। হাতে বেশি সময় থাকলে দেখতিস সমস্ত ব্যাপারটা তোর কাছে কেমন অফিশিয়াল করে তুলতো। একটা আস্ত ছতলা কোম্পানির পাকস্থলীতে আইঢাই করে মরতিস তখন। ছেড়ে দে। ওকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই, ওর আর আমাদের পথ তো আর এক নয়, ওর পথে ও চলবে–
খোকা বললে, এখন আলাদা হলেও, এক পথও তো হতে পারে? ধর এজেন্সি একটা নিলাম, তখন?
বলেছে নাকি এসব?
তা-না হলে আর বলছি কেন?
সর্বনাশ! দ্যাখ কেমন ঘাড়ে চাপে এবার, সকাল-সন্ধ্যা পাগল করে তুলবে তোকে!
অনেকক্ষণ পর খোকা বললে, এইভাবেই হন্টন মারবি নাকি?
রিকশা নে, ভালো লাগছে না কিছু। চল কোথাও গিয়ে বসি দুদণ্ড!
এক একবার ঘরে ফেরার ইচ্ছে উঁকি মারছিলো খোকার মনে। রঞ্জুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে আজ। সেজখালাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে দিয়েছিলো রজু বারবার। কিন্তু মুরাদকে ছেড়ে এই মুহূর্তে হুট করে চলে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব। গাছের ভিজে পাতার গায়ে নিরুপদ্রব জ্যোছনার আলোর মতো এক নরোম উজ্জ্বলতায় চিকচিক করছে মুরাদের চোখমুখ। মাঝে মাঝে চলকে উঠছে, নিজেকে চেপে রাখতে পারছে না, কিছু একটা প্রবলভাবে তোলপাড় করে চলেছে তার ভিতর, বুঝতে বাকি থাকে না খোকার।
খোকা বললে, কোথায় যাবি। কোনো বারে নয় কিন্তু!
সে রকম পয়সা কোথায়?
পয়সা আছে, কিন্তু ইচ্ছে নেই।
তা বটে, ইচ্ছে থাকলে পয়সা থাকে না। আউটার স্টেডিয়ামের দিকে যাওয়া যাক বরং–
ওদিকে বেজায় ভিড়ভাট্টা। মিটিং হুটোপুটি আর খেল তামাশায় কাদার মতো বজবজ করছে মাঠটা। যে শালার মুখে সবেমাত্র বুলি ফুটেছে সেও একচোট বক্তিমে না ঝেড়ে যাচ্ছে না; সাধে কি আর বলে হুজ্জতে বঙ্গাল! আমি দেখলাম, শালার বিকেলে মাঠে খেলা দেখার মতো। একদল লোকের মিটিং-এর নেশা আছে; আসন গেড়ে বসে পুটুর পুটুর, করে চিনেবাদাম ভেঙে গালে পোরে আর লেকচার শোনে, হাত তুলতে