অঞ্জু আর মঞ্জু হারিয়ে গিয়েছিলো কিভাবে?
বাথরুমের আয়নার মতো সেই পারদ ওঠা ঝাপসা ছবিটি ঝাড়পোঁছ করে খোকা; মামাবাড়ির পুকুরের শ্যাওলা ধরা শানে পা হড়কে পানিতে ছিটকে পড়লো অঞ্জু, আর দুহাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেল মঞ্জু, তারপর অঞ্জু মঞ্জুকে টেনে নিয়ে গেল আরো গভীরে, শেষে অঞ্জু আর মঞ্জু, মঞ্জু আর অঞ্জু, অঞ্জু, মঞ্জু ম মঞ্জু গলা জড়াজড়ি করে ডুবে মরলো।
এক সময় মুরাদের ওখানে পৌঁছালো খোকা।
মুরাদ বললে, এসে ভালোই করেছিস, আমাকে শুধু শুধু ফিরে আসতে হতো তোর বাড়ি থেকে। এই একটু পরেই বেরুচ্ছিলাম।
চা এলো এবং কিছুক্ষণ গুলতানি চললো। ঠিক ভালো লাগছিলো না খোকার, এমন কি এ কথাও একবার মনে উঁকি দিলো, আজ ঘর থেকে না বেরুলেই বোধ হয় ভালো ছিলো।
জমছে না, চল বাইরে বেরোই বরং–
একটু বোস, বড়বোন তোর সঙ্গে কথা বলবে।
খোকার ভিতরে একটা হাইপোস্টাইল হল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে এ কথায়।
আমার সঙ্গে আবার কিসের আলাপ?
কি জানি–গা ছেড়ে দিয়ে আলগোছে বললে মুরাদ।
একটু পরেই লুলু চৌধুরী ঢুকলো ঘরে। এসে একটা বেতের চেয়ার টেনে বসলো। হেসে জিগ্যেস করলে, কেমন আছেন?
ভালোই।
আপনাদের ওদিকে কেমন, গণ্ডগোল আছে কোনো রকম?
না, তেমন আর কই।
বড় হইচই আমাদের এই দিকটায়। কতো রকমেরই যে তোড়জোড়, একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি!
কোথায় আর! আমি তো দেখছি দিব্যি আরামেই আছেন আপনারা!
তাই বুঝি মনে হচ্ছে?
খোকার মনে হলো নীলাভাবীর সঙ্গে কোথায় একটা মিল আছে লুলু চৌধুরীর।
হঠাৎ কি মনে করে মুরাদ উঠে গেল এই সময়। খোকা দেখলো তার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
একটা কথা জিগ্যেস করবো আপনাকে, আপত্তি নেই তো?
আপত্তি কিসের! খোকার ভিতরটা এইবার সত্যি কেঁপে ওঠে।
আমি কারো নাম ধরে বলবো না। আমার চলাফেরা গতিবিধি এইসব নিয়ে মুরাদের বন্ধুদের অনেকেরই শুনি দারুণ মাথাব্যথা। আজকাল নাকি সেটার প্রকোপ একটু বেশি রকমেরই দেখা যাচ্ছে, এটা কি সত্যি?
খোকা আমতা আমতা করে বললে, এসব প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো। মধ্যে থেকে আমি বিপদে পড়ে যাচ্ছি–
আপনি সঙ্কোচ করছেন কেন? আমি কিন্তু আপনাকে বাদ দিয়েই কথাটা পেড়েছি। আপনার কাছে একথা তোলার একটাই কারণ, ওর বন্ধুদের ভিতর একমাত্র আপনার সঙ্গেই আমার আলাপ আছে, আপনাকে ভালো করে চিনি। ছিটেফোঁটা তো দূরের কথা, অন্যদের কাউকে চিনিই না, আর যেসব কথা শুনি তাতে চেনার খুব একটা ইচ্ছেও নেই। সঙ্কোচ
করবেন না, আপনি স্বচ্ছন্দে বলুন!
খোকা অপরাধীর মতো বললে, কিছু কিছু আলাপ হয় বৈকি!
কি ধরনের আলাপ? বেশ জোর দিয়ে জিগ্যেস করে লুলু চৌধুরী।
আন্দাজ করে নিন।
এটা কিন্তু ঠিক বললেন না। অন্যেরা কে কোন্ চোখে আমাকে দ্যাখে, তাদের কার কি রুচি শিক্ষা-দীক্ষা, তাতো আর আমার জানা নেই, খুব শক্ত আমার পক্ষে তা আন্দাজ করা–
আপনি বরং মুরাদের সঙ্গে আলাপ করবেন, মোটামুটি ও সবই জানে–
ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে–একটু থেমে হাসতে হাসতে লুলু। চৌধুরী বললে, শুধু কথা হয়েছে বললে ভুল বলা হবে, ছোটোখাটো একচোট হয়ে গেছে বলতে পারেন দুজনের মধ্যে!
মুরাদ নিশ্চয়ই কিছু কিছু বলেছে আপনাকে?
বলেছে, তবে সেগুলো না বললে ও ওর চলতো। নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি কাদা ছোড়াছুড়িকে আমি সাংঘাতিক ঘৃণা করি। ও যা যা বলেছে সেসব শুনে মন খারাপ করার কোনো মানে হয় না। দেখুন, এটা অত্যন্ত সত্যি কথা যে আমার চাল–চলন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়, বরং কিছুটা আমার নিজের মর্জিমতো বলতে পারেন। মানে এই নয়, আমি অসাধারণ একটা কিছু। এখানে আমার পেশার কথাটা সবাইকে শুধু ভেবে নয়, বিবেচনা করে দেখতে হবে। তুচ্ছ কানাকানিতে কান পেতে বসে থাকলে আমার চলবে না, এ তো আপনি বোঝেনই। নিরর্থক সময় অপব্যয় করা ছাড়া ওটা অন্য কিছু নয়। আমাকে সবসময় আমার পেশার কথা ভেবে চলতে হয়। আমি যে কোনো কিছুর পরোয়া করি না, লাজ-লজ্জার ধার ধারি না, এসব নিয়ে কানাকানি করা আর নিছক বদনামের জন্যে বদনাম করা এক কথা। এসব একপেশে কানাকানির আমি মোটেই দাম দিতে শিখি নি।
লুলু চৌধুরী থামলেও কোনো প্রত্যুত্তর করলো না খোকা। কেবল তার ভয়টা অনেক হালকা হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যথেষ্ট সংযমী মহিলা এই লুলু চৌধুরী, প্রায় আচ্ছন্নভাবে প্রয়োজন কি সে তা ধরতে পারলো না, সুকৌশলে ধোলাই চলছে না তো!
অর্ধেক জবাবদিহি দুনিয়াসুদ্ধ সবাই মেনে নিয়েছে এমনি ধরনের এক ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো আবার লুলু চৌধুরী, তারপর ধরুন অনেক সময় অসময়ে ঘরে ফিরতে হয় আমাকে। অনেক সময় অনেক মহারথীর সঙ্গে সময়ও কাটাতে হয়। চাকরির খাতিরে আমি এসবে বাধ্য। এমন নয় এটা সময়ের অপচয়, এতে আপত্তি কিসের! আমার চাকরির ধরনটাই অমন। দুনিয়ায় হাজারো রকমের মানুষ। কতো রকমের মেজাজ, অহমিকা, তেত্রিশ কোটি কমপ্লেক্স, মাথা খারাপ হয়ে যায় ভাই–
একটু থেমে মৃদু হেসে লুলু চৌধুরী বললে, কারো কান ধরে কাজ আদায় করে নিতে হয়, কারো হাত ধরে; অনেক সময় গলাও ধরতে হয়। অনেকের। যে উদ্দেশ্যে কান ধরা, সেই উদ্দেশ্যেই গলা ধরা। সব ব্যাপারটাই আগাগোড়া একটা টাস্ক, যা সম্পূর্ণই অফিশিয়াল। অবশ্য অনেকে এক্সপ্লয়টেশনও বলে থাকে; বয়েই গেল আমাদের। প্রিমিয়ামের মোটা অঙ্কের মূল্য কষে পা বাড়াতে হয় আমাদের। এই যে ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে গণ্ডায় গণ্ডায় কোম্পানি গজিয়ে উঠছে, ভুশ ভুশ করে কেঁপে উঠছে চোখের পলক না পড়তেই, এসব কি আর এমনি এমনিই! চাকরি চাকরিই, যে যার নিজের প্রতিভা দিয়ে কোম্পানির ভিত মজবুত করে চলেছে; ঠুনকো অহমিকা, শস্তা চক্ষুলজ্জা, অমুকে ছুঁয়ে দিলো, জাত গেল, এসবের চেয়ে এফিশিয়েন্সি রিপোর্টের দাম আমাদের কাছে ঢের ঢের বেশি! পারলে বন্ধুদের বলবেন, নিরর্থক কষ্ট করে তারা যেন আমার জন্যে দুশ্চিন্তা না করেন, আমি চাই না আমার নিজের ভালোমন্দের ব্যাপারে অন্যেরা খামোকা মাথা ঘামাক–