খোকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কি অবসাদ ঝিঝি ঝিনঝিনে শরীরে! বিতৃষ্ণা,–এতো বিতৃষ্ণা কেন, আকাশ ঝামরে ঢল নামছে বিতৃষ্ণার।
রামপুরার দিকে বাঁক নিলো রিকশা।
রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপরে সদ্য বাঁধানো একটি কবর; কয়েকদিন আগে একজন ছাত্রকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কাণ্ডজ্ঞানহীন সৈন্যরা। সিলকের কাপড়ে বড় বড় লাল অক্ষরের একটি লেখা কবরের উপরে ফরফর করে উড়ছে–তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। নিদারুণ চিত্তচাঞ্চল্যে ভিতরের নিস্তরঙ্গ হদ ঘুলিয়ে উঠলো খোকার। সারা দেশ চামুণ্ডার মতো
রক্তলোলুপ জিভ বের করে রেখেছে, রক্ত দাও, রক্ত দাও, আর রক্ত দাও। কবিতার একটি বই বেরিয়েছে কয়েক মাস আগে, তারও নাম, প্রেমাংশুর রক্ত চাই, জোর করে দেওয়া নাম। রেসকোর্সের মিটিং এর যে ভাষণ, সেখানেও ওই একই কথা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো—
এদেশের বৃষ্টির পানিতে আর ফসল ফলবে না, ফসল ফলাতে হলে বৃষ্টির বদলে চাই রক্ত। পুষ্পকুঞ্জ শুকিয়ে যাবে যদি তার গোড়ায় রক্ত না ঢালা হয়। এদেশের কেউ কবিতা পড়বে না যদি তা রক্তে লেখা না হয়। আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো কিংবা লাল ঢাকা রাজপথ, লাল ঢাকা। রাজপথ এই হলো গান, কেবল এইসবই গাওয়া হবে।
লেবু, ময়না, নুরুদ্দিন, মুরাদ, লুলু চৌধুরী, বেলী সবাইকেই কি রক্ত দিতে হবে? কতোখানি রক্ত? নখ কাটতে গিয়ে যতোখানি, না একটা হাত বাদ হয়ে গেলে যতোটা ঝরে? নাকি গলাকাটা রক্ত, ফায়ার ব্রিগেডের নলের পানির মতো হলহলিয়ে বগবগ করে যা বেরিয়ে আসবে!
রিকশার উপরে খোকা দুলতে থাকে।
আমাকেও দিতে হবে?
রঞ্জু?
আমাকে রঞ্জুকে, রঞ্জুকে আমাকে?
যদি না দিই?
দেবো না! এক মুহূর্তে ব্যারিকেড হয়ে যায় খোকা; আমরা রক্ত দিতে শিখি নি! যে দেশ রক্ত দাও, রক্ত দাও বলে দুশো বছর ধরে চিৎকার করে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশমাতৃকা তুই নস! যে দেশ কেবল জন্মান্ধ রাক্ষসপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্রকে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভূরিভোজের উৎসবে নিমন্ত্রণ করে হাঙরকে, তাকে বিশ্বাস নেই, দেশমাতৃকা তুই নস!
প্রবলভাবে আলোড়িত হতে থাকে খোকা। দুপাশের গাছপালা লক্ষ লক্ষ সবুজ টুপিপরা স্বেচ্ছাসেবক এখন খোকার কাছে। তার মনে হলো নির্বিকার স্বেচ্ছাসেবকেরা জড় ভাঙছে। এখন। ফিসফিস করে বলছে, আপনার মানসিক শান্তি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব আপনার নিজের, ষড়যন্ত্র চলছে!
অসম্ভব দীর্ঘ হাঁ হাঁ খাঁ খাঁ চৈতালী দুপুর লাঠি হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে গাছগুলো, পাখিরা উড়ে যাও, নীড় রচনা করতে পারবে না এখন এখানে, কালবৈশাখী আসন্ন!
তপ্ত বাতাসের হলকা গাছের পাশ কাটিয়ে কি তীব্র বয়ে যাচ্ছে! অনেক উঁচুতে উঠেছে আকাশ, ফেলে দিয়েছে সব মই; সকল নিস্তব্ধতার ভিতর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ভয় নিষ্পলক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কে চায় গায়ে আঁচড়টি লাগুক?
বাংলাদেশ, তুমি শুয়ে আছো অর্ধেন্দু দস্তিদার হয়ে, থেকে থেকে কাতরাচ্ছো, বোমা বিস্ফোরণে নিদারুণ ক্ষত-বিক্ষত তোমার মুখ; তোমার মুখ পুড়ে গেছে। বাংলাদেশ, তুমি মরে গেছ প্রীতিলতার মতো বিষপান করে। বাংলাদেশ, তুমি বুলেটবিদ্ধা আনোয়ারা, কোলের শিশুকে স্তন দিতে চাও? বাংলাদেশ, তুমি রাক্ষসী, একটা শালিকের মতো শিকার করেছো মতিয়ুরকে। বাংলাদেশ তুমি কারফিউ, গভীর রাতে যার বস্ত্র হরণ করতে গিয়ে মারা পড়েছি আমরা। তুমি টর্নেডো, বাংলাদেশ তুমি সাইক্লোন, বারবার সমুদ্রে ভাসিয়ে দাও তুমি আমাদের, হাঙরের পাকস্থলীতে বসে সুর করে তেলওয়াত করি আমরা। তুমি গর্ভিণী পুলোমা, বাংলাদেশ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষস কাম, একটু পরেই সে তোমাকে বলাৎকারের চণ্ড লালসায় হাত মুচড়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে গভীর নিভৃত অরণ্যে। বাংলাদেশ তুমি কিছুই নও, আবার তুমি সব; তুমি বাংলামদের একটা বোতল, মাতাল হবার তুঙ্গ অভিপ্রায়ে খালি করে গড়িয়ে দিয়েছি তোমাকে, এখন পায়ে পায়ে গড়াবে তুমি। বাংলাদেশ তুমি একটা সস্তা মদের দোকান, কে শুড়ি কে-বা তার সাক্ষী তার কোনো হিসেব নেই সেখানে। বাংলাদেশ তুমি একটা ছমছমে ঘুটঘুটে বেশ্যালয়, যার সব কুঠরি এক একটি বেলীর বাগান, যেখানে কখনো কাউকে ভূতে পায়, যেখানে জং ধরা কবজার মতো কর্কশ হিজড়েরা খ্যামটা নাচে, যেখানে ষাট বছরের বেততা মাসী নাঙ ধরে, যেখানে বেড়ানো বদনায় সাতনরীর হার ঝুমকা অনন্ত কানপাশা, যেখানে তাস পাশা জুয়া কড়িখেলা, যেখানে উপদংশ আর সন্ন্যাস রোগ, যেখানে শিকড় তুকতাক ঝাড়ফুক ঢোলের মতো মাদুলি, যেখানে ক্ষুধার্ত কাকের ঠোঁটে গর্ভপাতের লাল নাড়ি, যেখানে ঝুলকালিধরা ঘুলঘুলির টিমটিমে প্রদীপের শিখা বরাবর উদ্বন্ধনে ঝোলা জোড়াপা শূন্যে দোল খায়। লাল পেটিকোটের কষি আলগা করে বজবজে ঠাণ্ডা কুয়োতলায় নীল-সবুজ শ্যাওলায় উদোম বুকে-পিঠে-বগলে ভোসা কিংবা গামছা কিংবা ছোবড়া কিংবা চিবানো শজনে কিংবা দুর্বা কিংবা চড়ুইপাখির বাসা ডলছো তুমি, বাংলাদেশ তুমি একটা লক্ষ বছরের বেতো ডাইনী মাসী, ঘেয়োকুত্তার মতো নাঙ ধরেছে এক হাজার, ঘাটের মড়ার মতো না ধরেছো এক হাজার, ধোয়াঘাটের মুলোর মতো নাঙ ধরেছো এক হাজার, আর তোমার থলথলে পেটের রবরবা চর্বিতে সুড়সুড়ি না দিয়ে, তোমার সিংহমার্কা তামার পয়সা লাল পলা আর কড়িগাঁথা ঘুনসি জড়ানো গরুগাড়ির চাকার ক্ষতে দুষ্ট কোমরের খরখরে তেঁতুলেবিছায় তেল মালিশ না করে, খালপাড়ে যাবার অছিলায় বদনা হাতে সেই সব নাঙ ফতুর করে দিয়েছে তোমাকে তিন হাজারবার!