ভালোই মানিয়েছে নামটা বেলীর!
স্টেডিয়ামের চার পাশেই ভিড়, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা পাকাচ্ছে মানুষজন। রিকশার উপর দাঁড়িয়ে স্প্রিং-এর মতো হাত নেড়ে মরিয়া হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে কয়েকজন : আপনারা ভুলে যাবেন না, ভাইসব, মনে রাখা দরকার গোটা বিশ্ব আজ আমাদের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ হঠকারিদের চক্রান্তে পড়ে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। তাকিয়ে দেখুন সংগ্রামী ভিয়েতনামের দিকে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কীভাবেই না সেখানকার সংগ্রামী জনতা মোকাবিলা করে চলেছে, এবং একই সাথে প্যারিসে চলেছে শান্তি আলোচনা। আলোচনার পথ যদি রদ্ধ হয়, সংগ্রামের ক্ষেত্র তো আছেই–
হঠাৎ মুরাদের কথা মনে পড়ে যায় খোকার। সাত তারিখে একসঙ্গে রেসকোর্স গ্রাউন্ডে যাবার কথা ছিলো, শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। একটা খালি রিকশা দেখে খোকা এগিয়ে গেলেও তার আগেই লাফিয়ে উঠলো অপর একজন উষ্কখুস্ক যুবক। উঠেই চিৎকার করে বললে : বন্দুকের নল থেকেই বেরিয়ে আসে প্রকৃত ক্ষমতা, ভাইসব, ভাইসব, আপনারা যাত্রা-থিয়েটার দেখে অনেক সময় নষ্ট করেছেন, এবার হাতে অস্ত্র তুলে নিন–
হই হই করে ছুটে এলো একদল, শুরু হলো ছোটাছুটি, হুটোপুটি। খোকা দৌড়ে একটা রিকশায় উঠলো। বললে, রামপুরায় চলো—
রামপুরায় টেলিভিশন কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে মুরাদরা। অকারণে মুরাদের জন্যে মন খারাপ হলো খোকার। ঐদিন সত্যিই তর্ক করতে নেমে যাচ্ছেতাই অপমান করে ফেলেছে সে। শুধু অপমানই নয়, যথেষ্ট আঘাতও দিয়েছে। সন্দেহ নেই সেদিন সে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ওভাবে মুরাদের বড়বোনের প্রসঙ্গ তোলা উচিত হয় নি তার; নোংরামির একেবারে চূড়ান্ত করে ছেড়েছিলো সে। মুরাদ নিজেও খুব ভালো করে জানে, রেক্সে বসে গুলতানি মারার সময় বন্ধুরা প্রায় সবাই তার বোন লুলু চৌধুরীকে নিয়ে কদর্যভাবে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করে, কেবল খোকা এই দলের বাইরে। লুলু চৌধুরীর পাছাটা ঠিক যেন একটা আধমুনে ধামা, একটা চোস্ত খাজুরাহো, লুলু চৌধুরীর নদগড়ে পাছা দুলিয়ে হাঁটা, চুলটুলে চাহনি আর ফিক করে হাসা দিয়ে গোটা আদমজি জুট মিলটাই কেনা যায়, সেদিন স্বপ্ন দেখলাম ন্যাংটো হয়ে ঘোড়ায় চেপে সারা ঢাকা শহর টহল দিচ্ছে লুলু চৌধুরী, সাক্ষাৎ লেডিগোদিভা, লুলু চৌধুরীর শাড়ি পরার স্টাইলটা মারাত্মক, মনে হয় আর দেড় সেকেন্ডের ভিতর গা থেকে সব আবরণ ঝরঝর করে খুলে পড়ে যাবে, হামেশাই মওলা রহমান নুরুদ্দিনদের মুখ থেকে এইসব মন্তব্য শোনা যায়।
লজ্জিত হয় খোকা। মুরাদ তাকে আলাদা চোখে দেখে বলেই বিয়ার খেতে খেতে খুব দুঃখ করে নিজের বোনের প্রসঙ্গ তুলেছিলো। মনের জোর আছে মুরাদের, খোকা নিজেই মর্যাদা রাখতে পারে নি। খুব ছোট হয়ে গিয়েছে সে।
রিকশায় বসে খোকা ভাবতে থাকে, দিন দিন আমি একটা চাড়াল হয়ে যাচ্ছি, চাষাভষোর মতো যখন মুখে যা আসে তাই বলি, ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না কোনো কিছুর; লুলু চৌধুরী যে পাড়ার খাতায় নাম লেখানো বেশ্যা নয়, তার বন্ধুর বড় বোন, একথা ভালো করে ভাবা উচিত ছিলো। তার সেদিনের সেই কদর্য মন্তব্য থেকে দুয়ের তফাত ধরা যায় না।
এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে কোনো একসময় বেলীর মতো উচ্ছনে যাবে রঞ্জু। তখন! রঞ্জু সম্পর্কে বন্ধুরা তার কানে বিষ ঢাললে কেমন লাগবে তা শুনতে! এখনো যে রঞ্জুকে নিয়ে পিছনে পিছনে মনগড়া মন্তব্য করছে না, জোর করে তা বলা যায় না। ওদের যা গাছে গরু চরানো স্বভাব, তাতে মন্তব্য না করাটাই অস্বাভাবিক।
খোকার চোখের সামনে কয়েকটি রাস্তা ও লিকলিকে লতা মৃদু মৃদু দোল খায়, এবং লতাগুলো এক সময় সাপ হয়ে যায়। তার বুকের ভিতরকুঠরির ফাঁকা কামরাগুলো গমগম করে বেজে ওঠে।
সাবধান হতে হবে এখন থেকে। মুরাদের পক্ষে যা অসম্ভব তার কাছে। তা অতি সহজ। লুলু চৌধুরীকে কড়কে দেয়ার ক্ষমতা মুরাদের নেই; রঞ্জুকে অতি সহজেই শাসনে রাখতে পারে সে, বয়েসে ছোট, এখনো চোখ ফোটেনি ওর। খোকার ভিতরের কর্তব্যবোধ দুপুরের রোদের মতোই চড়চড় করে ঝলসে উঠতে থাকে। লুলু চৌধুরী অথবা বেলীর মতো, অথবা দুজনের মাঝামাঝি অন্য কারো মতো পাগলামির নেশা কোনো অসতর্ক অসংলগ্ন মুহূর্তেও যাতে ওর মগজে ভর না করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে সেদিকে; রঞ্জুকে হতে হবে রঞ্জুর নিজের মতো, অবিচল নির্মেঘ গগনপটে একফোঁটা রঞ্জুকে আলতোভাবে শুইয়ে নিপুণ সতর্কতায় একটার পর একটা ড্যাগার ছুড়তে থাকে সে, যেন চারপাশে গেঁথে যায়, যেন ড্যাগারের মৃত্যু আঁটুনি থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসতে
পারে। এক হাত-পা ছাড়া নির্বোধ অসহায়তাকে শাসন করতে থাকে খোকা; অবাক হয় সে নিজেই, তার স্বাভাবিক সংযম এক মুহূর্তে যেভাবে কালিমালিপ্ত হয়ে যায়, তাতে আর নিজের ওপরে সে তেমন আস্থা রাখতে পারে না। ধূম্রকেশর বিতৃষ্ণা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে খোকার। নিজের সঙ্গে এ এক ধরনের জটিল রহস্যময় বোঝাপড়া; অথবা ভৌতিক পাশাখেলা, কানাকড়িও বাজি ধরেনি, তবু অগোচরে সর্বস্বান্ত হয়ে চলেছে।
রঞ্জুর ব্যাপারে তাকে সতর্ক থাকতে হবে, ঢিলে দেওয়া চলবে না,জটিল কাটাকুটিতে ভরে যায় খোকার মন। অশ্বারোহী তাতারের মতো ধুলো উড়িয়ে তুমুল হেষারবে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত করে মেয়েদের বয়েস আসে না। ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে কখন যে হানাদার বয়েস এসে কানায় কানায় ছলাৎছল চলকে ওঠে তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। যেমন বেলী। এমনিতে আলস্যময় ঘুমের মতো চোখের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে সব, হঠাৎ একদিন এমন দুষ্কর্ম করে বসলো যে সকল ধারণার ভিত পর্যন্ত নড়ে গেল। বোঝা গেল বড় হয়ে গিয়েছে বেলী, তার বয়েস হয়েছে। বয়স না হলে সাহস দেবে কে, বাহবা পাবে কার কাছ থেকে? বয়েসের এই উন্মত্ত হাততালির ক্রমবর্ধমান পরিণতির নামই লুলু চৌধুরী; দুনিয়াসুদ্ধ উচ্ছনে গেলেও নিজের উদগ্র বয়সের কাছে নিজেকে তুঙ্গ করে তোলার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হবে না তখন, এ এক ধরনের বন্য হিংস্রতা, লোমশ মনোবৃত্তি, তিন কোটি তেত্রিশ লক্ষ স্তনভারাক্রান্ত দামাল লুলু চৌধুরী হার্ডল রেসের তীব্র প্রতিযোগিতায় বিশ্বময় ক্যাঙ্গারুর পালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলেছে, আর তাদের পায়ের তলায় পড়ে নাকমুখ দিয়ে সমানে গলগল করে রক্ত তুলছে রঞ্জু!