সত্যি, বেলীটা একটা ভ্যাম্পায়ার!
এই বেলীর জন্যেই মতিঝিল কলোনিতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে। তাকে। বেলী চায় সে নাচুক; ওই তিনজনের মতো তাকেও নাচাতে চায় বেলী। খোকার ক্ষেত্রে বেলীর নিজের সুবিধে অনেক বেশি, এসব ব্যাপারে ওর হিসেব সাধারণত নির্ভুল হয়। কখন কিভাবে কার দিকে ঝুঁকলে ফায়দা ওঠানো যাবে ও তা সহজেই অনুমান করে নেয়। পাকাপোক্ত একজন মেয়েমানুষের মতোই বেলী। সে ভালো করেই জেনে নিয়েছে তার হাতে আছে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার অতি প্রাচীন ডাকিনী বিদ্যা। এ ব্যাপারে অতটুকু মেয়ের যে নির্বিকারচিত্ততা, খোকাকে তা বিস্মিত করে।
তুই একটা হাড়কিপ্টে, নিয়ে চল না একদিন সিনেমায়—
একটা ভ্যানিটি ব্যাগ প্রেজেন্ট করবি?
তোর সঙ্গে একদিন সাংগ্রিলায় যাব, একজোড়া আইভরির দুল চাই আমার।
তুই কি ধরনের মেয়ে পছন্দ করিস, নার্স, টেলিফোন অপারেটর না হোলিক্রসে পড়া মেয়ে?
কেমন লাগে রে বিয়ার খেতে?
তুই ঘড়ি পরিস না কেন, আমার টাকা থাকলে একটা রোলেক্স কিনে দিতাম তোকে–
আচ্ছা বয়ফ্রেন্ডকে চুমু খেলে দোষ হয়?
এক একদিন এক একভাবে এগোয় বেলী। কখনো এগোয় পা টিপে। টিপে খুব সতর্কভাবে। অনুমানের বাইরে দুধাপ বেশি এগিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংশোধন করে নেয়; অতর্কিতে নিজেকে গুটিয়ে নেবার ক্ষমতাও তার বিপুল, তখন মনে হয় ওর মতো সংযমী দ্বিতীয়টি আর নেই। নানান কথার রাশ মেলে ধরার আড়ালে সে আত্মশাসন করে, খোকা বোঝে।
আবার উল্টোটিও ঘটে দুএকদিন। তখন তার বাইরের ধীরস্থির নিরুপদ্রব স্বভাবের আবরণ একটা দমকা হাওয়ায় খসে পড়ে।
একদিন দুপুরে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল বেলী। কোনো একটা চক্রান্ত ছিলো বেলীর, খোকা তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে নি; চক্রান্ত না থাকলে অকারণে কেউ অমন একরোখা হে হামলে পড়ে না।
ড্যাবড্যাব করে আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবি না, ভালো হবে না!
অমন বিদকুটে সং সেজেছিস কেন?
আমার ইচ্ছে, তুই বলার কে?
ঠিক আছে বাবা, ঘাট মানছি–ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিলো খোকা। হাতে একটা বই নিয়ে সেজখালার খাটে সে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। ঘরে বড়দের কেউ না থাকায় বেলীর তখন অবাধ স্বাধীনতা। সে পাখা মেলে দিয়েছিলো।
কথা বলছিস না যে বড়? আবার ঘাড় ঘোরানো হয়েছে! যদি কথা না বলিস মা ফিরে এলে তোর নামে নালিশ করবো।
কি নালিশ করবি শুনি?
বলবো জোর করে জাপ্টে ধরে তুই আমার গালে চুমু খেয়েছিস, ব্লাউস ছিড়ে দিয়েছিস; তুই মনে মনে যা যা কুচিন্তা করছিস, তার সবই বলবো। ভালোমানুষি ছুটিয়ে দেবো–
তোর যা ইচ্ছে করিস, এখন ভাগ, এখান থেকে ভাগ!
এহ, কি আমার ভাগানেওয়ালা রে!
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বেলী। সেজখালা ফিরে এলে আমি নিজেই নালিশ করবো তোর নামে, মার খাওয়াব তোকে!
কি বলে নালিশ দিবি?
সে তখন দেখা যাবে—
বলবি জোর করে জাপ্টে ধরে বেলী আমার গালে চুমু খেয়েছে, ঠিক আছে, তোর যা ইচ্ছে নালিশ করিস। মা তো আর বাঘ-ভালুক নয় যে কঁাচম্যাচ করে একেবারে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! না হয় দুঘা দেবে, ও আমার অনেক আগেই রপ্ত হয়ে আছে।
তোদের এখানে আর আসছি না, দেখে নিস! তুই একটা আঁচড়ে পাকা ফাজিল ছুঁড়ি, পৌঁনে তেরোটা বেজে গেছে তোর।
বেলী ঠোঁট উল্টিয়ে তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলো, বয়েই গেল, উনি আসায় বেজায় লাভ হচ্ছে কি না আমার। একটা সিনেমা দেখালেও তবু বলতাম হা দেখিয়েছিস একদিন, কি কঞ্জুস! চোখ খুলে কথা বল না, আমি কি ধুলোবালি না গাছের আঠা?
ধুলোবালি তো বটেই, ধুলোবালিতে ভর করা জীবাণু–
আর তুই একটা কেঁচো!
ঝটিতি হাতের বই ছুড়ে মেরেছিলো খোকা, কিন্তু গায়ে লাগেনি, খিলখিল করে হেসে একপাশে সরে গিয়েছিলো বেলী।
আমার নিজের বোন হলে জুতিয়ে সিধা করে দিতাম তোকে!
তোর নিজের বোনও তাহলে এইসব কথা বলে? হেসে গড়িয়ে পড়েছিলো বেলী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে।
মোটকথা ও বাড়িতে এই ছিলো তার শেষ দিন। আর ওমুখো হয় নি। খোকা এরপর। সেজখালার কানে কোনো কথা তুলে থাকবে বেলী, সেজখালার শীতল ব্যবহারে পরে এই ধরনের একটা সন্দেহ জন্মেছে তার মনে। বেলীর পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, হয়তো ভিতরে ভিতরে কোনো কূট অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যে তার সম্পর্কে মনগড়া কদর্য অভিযোগ তুলে সেজখালার মন ভেঙে দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে সেজখালা যখন তাদের ওখানে আসে তখন তার দিকে এমন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকায় যে খোকার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। তার বুঝতে অসুবিধে হয় না বেলীর দুঃসাহসী চালে সে ফেঁসে গিয়েছে। বেলী যে তাকে খোজে খোকা তাও জানে; তার ইচ্ছে যেভাবেই হোক খোকার সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে। দুএকবার হুজ করে একা একা চলে এসেছে সে বাড়িতে, কিন্তু সুবিধে করতে পারে নি; খোকা টিপে দিয়েছে রঞ্জুকে, সর্বক্ষণ ছায়ার মতো তার সঙ্গে লেগে থেকেছে রঞ্জু।
কোন্দিকে যাওয়া যায় এখন? স্টেডিয়ামের চারপাশে ঘোরাঘুরি করার ফাঁকে ফাঁকে মনস্থির করতে থাকে খোকা। এখন ইচ্ছে থাকলেও মতিঝিলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বেলী কি কদর্য একটা নাম। যে সব বন্ধু কালেভদ্রে পাড়ায় যাতায়াত করে খোকা তাদের মুখে শুনেছে। ওখানে নাকি খুব কদর বেলীর। মালা গেঁথে খোপা সাজায় মেয়েরা। বাবুদের হাতে হাতে শোভা পায়। ধুন্ধুমার গান-বাজনার ফাঁকে আধমাতাল বাবুর গলায় চৌদ্দ হাত দূর থেকে নির্ভুল তাক করে বেলীর মালা পরিয়ে দেওয়াটাও একটা পুরানো বৈঠকী কেতা। বাড়িউলী মাসীদের বেজায় পছন্দ ওই বেলী নামটি। কচুর লতি খাওয়ার মতো নেহাত সখ করে যে নামটা রাখা হয় তা নয়, কমলি, বিমলি, পটলি, মায়া, শান্তি, টগর–এসবের চেয়ে ওই নামটা নাকি বেজায় পয়মন্ত। কলতলায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে গোড়ালিতে ঝামা ঘষতে ঘষতে অবাক বিস্ময়ে দ্যাখে ওই নামের গাছটির ডালপালা তো দূরের কথা, পাতাটি পর্যন্ত দেখা যায় না এতো পাখি উড়ে এসে বসে ওই গাছে। নুরুদ্দিন গল্প করেছিলো, একবার সে ভৈরবের বাজেপট্টিতে এমন এক মাসীকে দেখেছে, যার সবকটি মেয়ের নামই বেলী। কালা বেলী, ধাওলা বেলী, শুটকি বেলী, ধুমসী বেলী, গন্নাকাটা বেলী, খ্যাংরাগুপোরপিয়ারী বেলী, তাড়কা রাক্ষসী বেলী, দেখনহাসি বেলী, খাদা বেলী, টিপকপালে বেলী, খুঁচিখোঁপা বেলী, বড়িখোপা বেলী, এইভাবে আলাদা করে ডাকা হয়। তাদের। এলাকাটির নামই নাকি বেলীর বাগান। হাটে-বাজারে-গঞ্জে প্রায়ই নানা জাতের গুজব রটে সেখানে; বেলীর বাগানকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় গুজবের উৎপত্তি। যেমন, বেলীর বাগানে আজ জোড়াখুন হয়েছে, বেলীর বাগানে আজ হিজড়েরা জব্বোর নাচ নেচে গেছে, বেলীর বাগানে আজ একজনের পেট থেকে দুমাথাওয়ালা সাপ বেরিয়েছে, বেলীর বাগানের মাসীর খাড়া নতুন নাঙ বদনার ভিতরে ভরে সত্তর ভরির গহনা নিয়ে ভেগেছে, এসব।