তবু এই নিরালম্ব মুহূর্তে ওসব পথে পা বাড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। আসল কথা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে তার খুব একটা জমে
কখনোই। সাধারণত ধারেকাছে ঘেসে না, এড়িয়ে চলে; নিজেরাই উপযাচক হয়ে প্রায় সকলেই কালেভদ্রে খোঁজখবর নিয়ে যায়। অভিযোগের পাহাড় জমা হয়। এই নিয়ে রঞ্জুর সঙ্গে তার মাঝে মাঝে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। নিজের অনুপস্থিতিতে খোকা যখন আত্মীয়স্বজনের কাছে তিরস্কৃত হয় তখন ভীষণ খারাপ লাগে রঞ্জু র; খোকা নারাজ এসব কানে তুলতে, তার ধারণা এইসব মাখামাখি এক ধরনের স্থূল গ্রাম্যতা, সুখ বলতে সে বোঝে নিরুপদ্রব থাকা।
মতিঝিলে সেজখালার ওখানে আগে প্রায়ই ঘোটা কাটতে খোকা; সেজখালার কাছে তারা বড় আদরের পাত্র। সেজখালার ওখানে। গেলেই মার কথা শুনতে হয় খোকাকে; অনেক সময় তার ভালো লাগে না, একঘেয়ে মনে হয়, তবু শুনতে হয়। কি ভালোবাসতো, কবে কি কথা নিয়ে রাগারাগি হয়েছিলো, কিভাবে দুহাতে সব বিলিয়ে দেয়ার অভ্যেস ছিলো, রাজ্যির সব বৃত্তান্ত। বিয়ের পরও মা রেডিয়োতে গান গাইত, খ্যাতি অর্জন করেছিলো প্রচুর; তখনকার দিনে কোনো রেকর্ড কোম্পানি ছিলো না বলে আপসোসের আর শেষ নেই সেজখালার।
এখন আর সহজে ও পথ মাড়ায় না খোকা। বেলী বড় হবার পর থেকে সেজখালার বাড়ি মাড়ানো এক রকম ছেড়ে দিয়েছে খোকা। মার স্মৃতি, যা অতিদ্রুত তার কাছে ঝাপসা এবং ধূসর হয়ে গিয়েছে, বারবার একই সুরে তা নাড়াচাড়া করতে তার ভালো লাগে না। যা নেই কিংবা যা কখনো হবে না, তা নিয়ে অযথা মাথা কোটাকুটি করাটাও তার কাছে এক ধরনের গ্রাম্যতা, এইসব ফাঁপা হা-হুতাশে সে পচা বাশপাতার গন্ধ পায়। সেজখালা একটা রোগের মতো এইসব হা-হুতাশ নিজের ভিতর পুষে রেখেছে।
বাইরে থেকে দেখলে একটি অতি সাধারণ মেয়ে বেলী, যার বয়েস পনেরো থেকে যোলো। লেখাপড়ায় মাঝামাঝি, ফি-বার ক্লাসে ওঠে, স্কুলের ফাংশনে মণিপুরী নাচ নাচে, ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখে ছোট ভাইবোনদের ফুল চুরিতে উৎসাহিত করে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা বাসন্তী রঙের লালপেড়ে শাড়ি পরে শহীদ মিনারে যায়, চলনে-বলনে সুন্দর, সুশ্রী; কিন্তু পরিবারের ভিতর থেকে খোকা দেখতে পেল এমন অনেক কিছুই করে বেলী যা বাইরে থেকে ধরা পড়ে না। দেদার চিঠি লেখে সে সিনেমা ম্যাগাজিনের প্রশ্নোত্তর বিভাগে, নীহারগুপ্তের বই পড়ে আর দাগ মারে, নিজে পয়সা চুরি করে ছোটদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মার খাওয়ায়, এবং সেই পয়সায় মার্কেটে শপিং করে, লিপস্টিক কেনে। এই বয়েসেই লিপস্টিকের তুখোড় সমঝদার বনে গেছে বেলী। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা তার গুদামঘর। গুদাম বোঝাই হানি-ইন গোল্ড, টিজিং পিঙ্ক, কফি ক্যারামেল গুচ্ছের শেডের লিপস্টিক। ফরাসি সেন্ট আর মেকাপের সামগ্রীও তার সংগ্রহে কম নেই। তলে তলে একাধিক ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেমও করে, অর্থাৎ ইচ্ছেমতো বাঁদর নাচ নাচায়।
যারা তার সঙ্গে প্রেম করে তাদের কেউ চিকন মোড়ের পায়জামা আর ঢিলে পাঞ্জাবি পরে। শ্ৰীযুক্ত চারদত্ত আধারকারের জীবন। থেকে ঝেড়ে কোটেশান দিয়ে প্রেমপত্র লেখে। পিছনে হাত বেঁধে আড়চোখে ঠারেঠোরে চায় আর হরদম বাড়ির সামনে পায়চারি করে, এরই নাম নাকি ফিলডিং মারা। একটা ভোগেল, খোকা মনে মনে উচ্চারণ করে।
একজন আছে যে প্রায়ই রেসিং সাইকেলে চেপে বাড়ির সামনে রুটিন করে টহল মারে। সাইকেলের উপর উধ্বকমার মতো কুঁজো হয়ে দুমড়ে পড়ে আপনমনে ফিক ফিক করে হাসতে থাকে ছেলেটি। বাড়ির সামনে এলেই কায়দা মেরে দুহাত ছেড়ে দেয় সে, তারপর উপরমুখো হয়ে। বাইবাই করে চালানো শুরু করে। এই সময় তার ঠোঁটে মাষকলাইয়ের ডালের এঁটোর মতো যে হাসিটি লেগে থাকে, তা দেখে মনে হয় কলোনির এক হাজার ডবকা মেয়ে নিজেদের ভিতর চুলোচুলি করে ওর দুগালে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। নির্ঘাত ছিট আছে ছোকরার মাথায়, খোকার মনে হলো।
সবচেয়ে মারাত্মক টাইপ যেটার সাধারণত সে আসে রাত্রে, একটা লাল রঙের ফিয়াট কুপে চালায় ছোকরা। একটা ঝড়। ঝড়ের মতো গাড়ি চালায়। দিনের বেলায় খোকাহোক খো–কাহোক ধরনের হর্ন বাজিয়ে দুচারটে পাক মেরে যায়। তার মানে তুমি চাগিয়ে ওঠো, সেই রাত্রিবেলায় আমি আসবো। লাইটপোস্টের নিচে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়াবো। তারপর টাইম ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপনের মতো গাড়িতে হেলান দিয়ে কায়দা মেরে দাঁড়িয়ে কিং সাইজের ফিলটার টিপড় সিগ্রেট ধরাবো। ব্যাটাছেলে নিজেই একটা ফিলটার সিগ্রেট। পালক ছড়ানো সেদ্ধ হাঁসের মতো ফকফকে। ঝুলপি দুটি বিরাট। মনে হয় স্রেফ তার ঝুলপি নামাবার জন্যেই সৃষ্টিকর্তা ওর হুঁকোর খোলের মতো চোখমার্কা মুখটা দিয়েছেন; ওই ঝুলপি না থাকলে ও নিজেই কোর খোলটা ড্রেনে ফেলে দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে ছোকরা। ভাবখানা এই : আমি একটা চোঙা, কোন্ শালা আমায় ফোঁকে, আসুক দেখি। যথেষ্ট আছে ওর বাবার, বোঝা যায়; শালা শুয়োরের বাচ্চা, মনে মনে গাল দেয় খোকা।
তবু, এদের হয়তো কোনো দোষই নেই, এক একবার মনে হয় খোকার। ওদের নাচাচ্ছে বেলী। অদৃষ্টের মতো ওদের খেলিয়ে মজা লুটছে; ওরা নাচছে, পাগলের মতো নাচছে।
একদিন তো সামান্য একটুর জন্যে নেহাত ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছে বেচারা ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি-পায়জামা! লম্বা ঝুলপির কুপে অতিশয় লাল চোখ হয়ে বুনো শুয়োরের মতো গাঁক গাঁক করে দাবড়ানি দিয়েছিলো তাকে; কাদাপানিতে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আলুভর্তা হয়ে যেত বেচারা সেদিন। গাড়ির ভিতর থেকে চিৎকার করে উঠেছিলো ছোকরা, মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেবো, শালা!