মওলা বললে, তোর সেই নারী শিক্ষা মন্দিরের বার্ষিক স্পোর্টসের কথা মনে আছে এখনো? পাঁচিলের আড়াল থেকে ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলি হার্ডল রেসের চারজন বেপর্দা ছুঁড়ির। একজন তো শেষ পর্যন্ত কানাই হয়ে গেল–
নুরুদ্দিন বললে, তোদের কাজই হলো স্রেফ পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটা!
বাহাদুর ছেলে বটে–রহমান বললে, ইজেলিদের সঙ্গে লড়বার জন্যে সাতজনের একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলি তুই, মালকোঁচা মেরে রোজ প্যারেড করতো ওরা ভার্সিটির গ্রাউন্ডে–
করতোই তো, তাতে খারাপটা কি দেখলি?
রহমান বললে, খারাপ ভালোর কথা তো হচ্ছে না, তোর জোশের কথা হচ্ছে; কেমন যেন একটু নেতিয়ে পড়েছিস আজকাল, তা না হলে আর্নল্ড টয়েনবির বয়ান তো এক সময় আমাদের জন্যে নিত্যবরাদ্দ ছিলো।
নুরুদ্দিন বললে, আমি যাই করে থাকি না কেন, কারো দালালি। করিনি কখনো। ছাত্রজীবনে সবাই একটা না একটা সংগঠনের পিছনে মাতামাতি করে থাকে, আর তুই? নিজের দিকটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ রহমান, উপরে খদ্দরের বর্ম, ইচ্ছে করে বক সিগ্রেট ধ্বংস করা, যতো যাই করিস না কেন তোকে চিনতেও আমার বাকি নেই। খামোকা কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই, তুই চাপিস করে যা!
হ্যাঁ সেই ভালো, তুই চাপিস করে যা রহমান, ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তোর কম্মো নয়, ও হলো জিনিস সদরঘাটের পিনিস, সারাসেনের হিস্ট্রি গিলে গিলে ওর পেট জয়ঢাক হয়ে আছে; ধোপে টিকবি তুই ওর কাছে। ওর তুলনায় চুনোপুঁটি তুই। একটু থেমে খোকা বললে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, জাতীয় সংহতিতে শালিমার গার্ডেনের ভূমিকা, হীররাঞ্জা আর খটক নৃত্যের সৌন্দর্য মাত্র এই চারটে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলি তুই টিভির জন্যে। তাও শালা মওলার চাপে পড়ে; ও শালাই তোকে ফাঁসিয়েছিলো। ও কিছু নয়, নুরুদ্দিনের কীর্তির তুলনায় এগুলো সব নস্যি। ও অনেক সিনিয়র আমাদের চেয়ে; খন্দকের যুদ্ধে ও ছিলো, বদরের যুদ্ধেও ছিলো, ও তারিকের সঙ্গে জিব্রাল্টারে গেছে, জয় করেছে স্পেন, গ্রানাডায় আলহামরা ওরই তৈরি, এমন তাড়ান তাড়িয়েছিলো ও আবু রুশদকে–
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নুরুদ্দিনের ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে মওলা বললে, ভ্যালিয়মের কথা মনে পড়ছে নাকি সিনিয়র?
ফালতু কথা ছাড়! নুরুদ্দিন খাউ করে উঠলো।
রহমান বললে, কি যে বলিস, ভ্যালিয়ম তো আজকাল সবসময় ওর পকেটেই থাকে: হাতড়ে বের করতে দেরি হয় বলে কলপের ঢিল রাখাও ছেড়ে দিয়েছে। প্রায়ই তো বলছে, হাত-পায়ের তলা ঘামে, মাথার ভিতরে একটা কাঠঠোকরা হরদম ঠোকর মারছে, জান ধড়ফড় করছে; চেকারের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে জানটা যে-কোনো সময় চলন্ত বগি থেকে ঘপাং করে লাফ দিতে পারে
তাহলে খামোশ হয়ে যা ভাই! মওলা বললে, হঠাৎ যদি ওর শরীর খারাপ করে!
খোকা বললে, খচে গেলি নাকি নুরুদ্দিন? আর এক রাউন্ড চা হয়ে যাক?
হোক।
তোর খারাপ লাগবে না? রহমান টিপ্পনি কাটে।
তা একটু লাগবে বৈকি! তবে সঙ্গে যদি সমুচা কিংবা ফুটকেক ধরনের কিছু থাকে, অন্তত ভালো লাগাবার চেষ্টার কোনো ত্রুটি হবে না!
চান্স লিচ্ছ ব্রাদার? রহমান বললে, অবশ্য এ হ্যাবিটটা তোর আজকের নয়!
গালে সমুচা পুরে খুব আঁক করে চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক মেরে নুরুদ্দিন বললে, এসব আমি গায়ে মাখি না, যার যা ইচ্ছে বলুক, তৃপ্তি পাচ্ছে, পাক! আসল কথা যেটা সেটা এই, কুকুর কুকুরকে দংশন। করছে!
রক্ষে করো, এক লাফে একেবারে চীনপন্থী হয়ে গেলি!
কেন চীনেমাটির কাপে চা খাচ্ছি বলে?
ওই এক ধরন তাদের, কখনো কখনো এমন কথা বলিস যা নিজেরাও বুঝিস না ভালোমতন–ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রহমান বললে, অবশ্য তোর দিক থেকে মস্ত একটা লাভ হয়েছে, পর পর কয়েকটা বছর একটানা সুরমা দেওয়ার ফলে চোখের ব্যামোটাই ছেড়ে গেছে। নাকি এখনো ট্রাবল দেয়?
খোকা বললে, ছেড়ে দে, বাজে কথা আর ভালো লাগছে না! ও শালা লেবু, বেশি কচলালে তিতকুটে মেরে যাবে! চল ওঠা যাক–
মওলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, আমাকেও উঠতে হবে, কাজ ফেলে এসেছি অনেক। এইরে, আবার একঝাক স্বেচ্ছাসেবক ঢুকেছে, চল চল কাটি–
রেক্স থেকে বেরিয়ে একটা পান গালে পপারে খোকা। এমনিতে সে পান খায় না; কিন্তু রেক্স থেকে বেরুনোর সঙ্গে গালে পান গোঁজার কোথায় একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, প্রতিবারই বেরুবার সময় গলির মুখটায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখ থেকে ফস্ করে পানের কথাটা বেরিয়ে যায়।
কোনদিকে যাওয়া যায় এখন। এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছেই নেই তার, যদিও বের হবার সময় পৈ পৈ করে বলে দিয়েছে রঞ্জু যতো শিগগির সম্ভব ফিরতে। নির্ঘাত কাঁইখাপ্পা হবে রঞ্জু। চটুক। খোকা মনে মনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় বেশি আস্কারা দেওয়া চলবে না, খবরদারির মাত্রা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, ভবিষ্যতে আরো অসুবিধায় ফেলতে পারে; আর কোনো গুণ থাকুক আর নাই থাকুক, হাতের মুঠো শক্ত করার বিদ্যায় সব মেয়েই কমবেশি পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে।
এই এক স্বভাব খোকার, ঘরে থাকলে জুবড়ে পড়ে থাকে বের হলে ঘরের কথা ভুলে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর যখন গুহা থেকে বের হয়, কিংবা নিশুতি রাত মাথায় করে সারা শহরকে ঘুম পাড়িয়ে যখন ঘরে ফেরে, তখন মনে মনে নিজেকে সংশোধন করার জন্যে তৈরি হয় খোকা; কিন্তু ওই পর্যন্তই!
আত্মীয়স্বজন খুব কম নেই ঢাকা শহরে। আর্মানিটোলায় এক মামা আছে। সিদ্ধেশ্বরীতে চাচা থাকে, একেবারে আপন না হলেও ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি! খালা-খালু, ভাই-বোনের আছে মতিঝিল কলোনিতে। ওদের সঙ্গে মিশে বেশ আনন্দও পায় সে।