নাকের ডগা থেকে ক্রিমের ফেনা মুছতে মুছতে খোকা জানতে চাইলো, এরকম মনে হওয়ার কারণটা জানতে পারি কি?
ক্যালেন্ডারের একটা তারিখের ওপর হাত বুলিয়ে ভাসা ভাসা গলায় রঞ্জু অনেক দূর থেকে বললে, অন্যবার বাপি আসার তারিখটা প্রায় মনেই থাকে নি, দেখতে না দেখতে দিন কেটে গিয়েছে, টেরই পাওয়া যায় নি, দেখা গেল হুট করে একদিন বাপি এসে হাজির। এবারে কোনো রকমেই আর তারিখটা আসতে চায় না; তারিখটা যেন পথ হারিয়ে ফেলে একটা উটের মতো মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে…!
মেইরেছে, এ শালার আর এক জেন ডিকসন! গতরাতে আমি একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি… কাছে সরে এসে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে রঞ্জু বললে, হাতিয়া-সন্দ্বীপের সাইক্লোনের সেই ফোলা ফোলা পচাখসা লাশগুলো খবরের কাগজ থেকে বের হয়ে অলিগলি, রাস্তাঘাট এখানে-ওখানে লুকোচুরি খেলছে আর কুরকুট্টি দিয়ে হাসছে!
বাঁ হাত দিয়ে রঞ্জুর বিনুনি ধরে মুঠো পাকালো খোকা। বললে, এইসা থাপ্পড় মারবো যে গুলতাপ্পি ভুলে যাবি! আব্বে খুঁড়ি, ওটা বোক্কাচিও সেভেনটির অনিতা, বেমালুম কপিরাইট ঝাড়ন্তিফাই করা হচ্ছে, এ্যাঁ!
ঠাট্টা নয়, বিশ্বাস কর দাদা, ভোররাতে মাকেও দেখলাম। অনেক দিন হলো তুই ঘরে ফিরিস নি, আমি একা থাকি আর ভয় নাই বলে মা আমার কাছে শুতে আসে, এইসব। তোর জন্যে মা খুব কাঁদলো। কবে নাকি তুই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে জুয়া খেলেছিস, হাতের আংটি বেচে দিয়েছিস, আরো অনেক অভিযোগ, পরিষ্কার মনেও নেই সব…
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, তাই বল! তোর স্বপ্নেরও দেখি মারাত্মক রকমের একটা মোরাল থাকে, তা ভালো…
দুৎ! সবকিছুতেই তোর ঠাট্টা!
খোকা একটা চিমটি দিয়ে বললে, মা তোর কাছে কান্নাকাটি তো করবেই, তুই তো আমার লোকাল গার্জেন…
গার্জেনই তো…
তবু ভালো, আজকাল আর আগেকার মতো কায়দা করে গার্জিয়েন বলিস না।
কিছু একটা ভেবে রঞ্জু বললে, বাড়িতে একটা মিলাদ-টিলাদের ব্যবস্থা কর না; আমার কেমন লাগছে কদিন থেকে।
চল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই তোকে।
রঞ্জু কোনো উত্তর দিল না। খুব বেশি হয় নি সে, বরং ধরে নিয়েছে।
এটা খোকার নিছক কুড়েমিসুলভ এক নিষ্ঠুরতা, পাছে আলসেমির ভাঁজ ভাঙে এই ভয়ে সে বহু কিছুই করতে নারাজ। রঞ্জু যে সন্তুষ্ট নয় এই মুহূর্তে অতি সহজেই তা খোকার কাছে ধরা পড়ে; বুঝতে অসুবিধা হয়।
ভিতরে ভিতরে ও কিভাবে গুমরে উঠছে।
বুঝলেও, বিশেষ কতোগুলো ক্ষেত্রে বেশি আমল দেওয়াটা খোকার স্বভাববিরুদ্ধ; রঞ্জুটা এখনো বড় ছেলেমানুষ…বরং এইভাবে ভাবতে তার ভালোলাগে, সে অভ্যস্ত ও এই জাতীয় ধরে নেওয়া চিন্তা-ভাবনায়। বিশেষ করে রঞ্জু যখন বয়েসে ছোট, জাতে মেয়ে, সর্বোপরি মাথার উপরে তেমন কেউ নেই, এক্ষেত্রে তার সব আকাঙ্ক্ষাই তার কাছে সুলভ অথবা সহজসাধ্য হোক খোকা তা চায় না। খোকা মনে করে এটা একটা সঙ্কট, ফলে তার পদক্ষেপ অযথা হিসেবের ফেরে পড়ে এবং তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা এক ধরনের সংস্কার, খোকা জানে। কিন্তু একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সে সজ্ঞানেই এই সংস্কারকে মেনে নিয়েছে। এই সংস্কার তার দায়-দায়িত্বকে অল্পবিস্তর আচ্ছন্ন করে রাখলেও খোকা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে ভালোবাসে।
খুব ছোটবেলায় একবার, বেশ মনে পড়ে খোকার–তখন মহামারী চলছে গোটা দেশ জুড়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে দুপয়সার চালতার আচার কিনে খেয়েছিলো সে ছেঁড়া ধুড়ধুড়ি ন্যাতাকাপড় জড়ানো এক নড়বড়ে বুড়োর কাছ থেকে; অথচ বারণ ছিলো, বারণ এবং কড়া পাহারা। তা সত্ত্বেও দুপয়সার আচার সেই বয়েসে এমন ঈপ্সিত এমন বাঞ্ছিত হয়ে উঠেছিলো যে নিষেধের বেড়া ডিঙাতে তিলবিন্দু দ্বিধান্বিত হয় নি সে। ফলে যা অনিবার্য তাই ঘটেছিলো, কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলো সে। মা তখনো বেঁচে; যমে-মানুষে টানাটানি যাকে বলে, সমানে তা-ই চললো। রঞ্জুর। ব্যাপারটা ঠিক এই ধরনের না হলেও খোকা তার বিচারের মাপকাঠি এইভাবেই তৈরি করেছে।
খুব ক্লান্ত দেখায় রঞ্জুকে। এতো মলিন কেন রঞ্জুর মুখ? মা মারা গিয়েছে আজ প্রায় দুবছর হতে চললো; এই দুবছরে রঞ্জুই তার সবচেয়ে ধারে-কাছের মানুষ, উঠতে বসতে দুবেলা সমানে সে তাকে দেখে। আসছে, অথচ অনেক কিছুই সে জানে না, বুঝতে পারে না, কখনো কখনো এমন দুর্বোধ্য এমন অচেনা মনে হয় রঞ্জুকে যার ফলে সে-ই খেই হারিয়ে ফেলে। কে জানে, হয়তো এই দীর্ঘ ছবছরে নিঃশব্দ
পদসঞ্চারে একটি ছায়া প্রসারিত হয়েছে রঞ্জুর মনের গহনে, যে ছায়া মানুষের একটি খণ্ডিত অতীতকে চিরকালের জন্যে অবিচলভাবে ধরে রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র ভবিষ্যৎকে। অনেক কিছুই মনে হয় খোকার; বিশেষ একটি অভাব বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মুখের ছবিটিকে বিষাদের আচ্ছন্নতায় হিম-শীতল করে তুলছে, বেঁচে থাকা উচিত ছিলো মার।
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে খোকা বললে, বাইরে বেরুনোর মতো জমা-কাপড় আছে তো?
বোধহয় আছে, দেখছি…
বোঝা গেল রঞ্জু চালাকিটার বিন্দু-বিসর্গও ধরতে পারে নি।
সত্যি, রঞ্জুটা একটা ল্যাঠা; এই আলো, এই আঁধার, থেকে থেকে একটা কিছু ঘটে ওর ভিতর। স্বভাবটাও তৈরি করেছে বিদঘুটে। ইসকুলের পাট চুকিয়ে এ বছর থেকেই কলেজে যাচ্ছে, ব্যাস্, ওই পর্যন্তই! সমবয়েসী কারো সঙ্গে মেলামেশা, ছিটেফোঁটা শপিং-এ বেরুনো, কোনো ফাংশন অথবা সিনেমায় যাওয়া, কখনো কোনো কিছুতেই ও নেই। সময়মতো কলেজে যাওয়া, লেবু আর ময়নাকে দিয়ে সংসারের কাজ গুছিয়ে নেওয়া, মাঝে মাঝে দুএকটা গল্প-উপন্যাসের পাতা ওল্টানো, নিজের পড়া করা, এইসব নিয়েই সময় পার হয়ে যায় রঞ্জুর। বাগানের ব্যাপারে তুমুল উৎসাহ ছিলো তার এক সময়। বাগান পরিচর্যার জন্যে রমনা পার্কের এক মালীর সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নিয়েছে তারা। হাতেম আলী অর্থাৎ ঐ গুণধর মালীরতুটি নিয়মিত তার মাসোহারাটি গুণে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাগানে আগাছা-কুগাছা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর তদারকি করেছে রঞ্জু, দুঘণ্টার মাঝে দম ফেলার ফুরসত মিলতো না ছোকরা হাতেম আলীর। কিন্তু এখন! সেখান থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে রঞ্জু। আগে হপ্তায় কদিন সে কামাই করছে রঞ্জুর তা হিসেব থাকতো, এখন গা ছেড়ে দিয়েছে। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবেই কিছু না কিছু পরিবর্তন। ঘটে, রঞ্জুর সেই পরিবর্তন কোন খাতে বয়ে চলেছে সে জানে না, গা ছমছম করে খোকার, তার অন্তরাত্মা কেঁপে যায়। তার নিজের এখন বাইশ বছর চলছে; টু লিটল ডাকস…টয়েন্টি টু তার মনে হয় না, তার মনে হয়। এক জোড়া উদ্ধত রাগী গোখরো ফণা তুলে রেখেছে তার দিকে, সুযোগ। পেলেই ছোবল মারবে।