মওলা ফোড়ন কেটে বললে, দেশের তাবৎ বিপ্লবীরা রহমানের ছোট ভাইয়ের বন্ধু; ভাগ্যবান বটে আমাদের রহমান। সোর্সটা ওর ভালোই, ভাইয়ের মতো ভাই পেয়েছে একখান্!
চায়ের কাপে চিনি নাড়তে নাড়তে বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় রহমান। বললে, আর যাই হোক ভাইটি আমার কারো দালালি করে না; রিলিফের কাজ পাড়ার সংগঠন এইসব নিয়ে মেতে থাকে।
মওলা চটে উঠলো। বললে, দালালিটা দেখলি কোথায়?
টিভির প্রোগ্রাম প্রডিউসার আবার কি, দালাল নয়? যেমন তৈরি হয়েই ছিলো উত্তর দেয়ার জন্যে, এইভাবে বললে রহমান, মৌলিক গণতন্ত্রী চোঙামার্কা ম্যাড়ামার্কা টিপিকে এইচপিকে নিয়ে ভ্যারেন্ডা ভাজতে ভাজতে যখন শালারা বুঝলে হাওয়া খারাপ, অমনি যেদিকে পড়ে পানি সেদিকে ধরো ছাতি ফর্মুলায় গনগনে আঁচে দেশপ্রেমের খিচুড়ি চাপিয়ে জ্বাল দিতে শুরু করেছিস। গামলায় কখন তেল রাখতে হবে আর কখন এ্যাসিড, তা তোরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই বুঝিস। তোরা অপচুনিস্ট, তোরা ক্যারিয়ারিস্ট, তোরাই সোস্যাল ক্লাইম্বার। তোরা হোয়াট নট। দাড়ি কামানোর রেজর থেকে শুরু করে ফুলদানি হরলিক্স-এর বোতল গেঞ্জি গামছা ন্যাকড়া-চোকড়া মায় জুতো পর্যন্ত রাখা যায় তোদের শেলফে।
মওলা ক্ষুন্ন হয়ে বললে, এমনভাবে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছিস যেন নেতৃত্ব দিতে চাস।
চোখ রাঙানোর কি আছে এতে? বাজে ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করিস তুই, সেধে ধোলাই খাস!
তোর কথা যদি সত্যি হয়, সারা দেশের লোকই দালাল!
তোর তো ওকথা মনে হবেই, নইলে আত্মরক্ষা হবে কি করে! পারবি আমাকে তুই দালাল বলতে? বল দেখি।
গায়ের জোরে আমি কাউকে দোষারোপ করি না–একটু থেমে মওলা বললে, তোরা এই হঠাৎ দেশপ্রেমিকের দল আজকাল যে লাইনে কথা বলছিস তাতে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে যে মালী ফুল ফুটিয়েছে সেও দালাল; এমন কি মুরগি যদি ডিম পেড়ে থাকে, তা দিয়ে। থাকে, বাচ্চা ফুটিয়ে থাকে, তাহলে সেও দালালি করেছে–
নুরুদ্দিন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো আর সিগ্রেট ফুঁকছিলো। সে। রহমানের পক্ষ নিয়ে বললে, কে দালালি করলে আর কে করলে না এসবে কিছু যায় আসে না। মালী কিংবা ধোপাও দালালি করতে পারে। মুরগিও যদি দালালি করে করুক, আপত্তি নেই, কেবল দেখতে হবে কার পাছায় কার ছাপ আছে। তোমাদের ওই টিভির চাকরিটাই হলো কবে, যার কাজই অহরহ কেবল ছাপ দেওয়া—
কি ভাই, আপনারা ঝগড়া করছেন নাকি? সবুজ টুপিপরা দুজন স্বেচ্ছাসেবক তড়িঘড়ি করে কাবাব উড়িয়ে হাতের চেটোয় মুখ মুছতে মুছতে এক কোণ থেকে উঠে এলো। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে সবিনয়ে বললে, আপনারা শিক্ষিত লোক এ সময়ে ঝগড়া করা শোভা পায় না আপনাদের। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব আমাদের সকলের; বঙ্গবন্ধু বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়, ষড়যন্ত্র চলছে!
রহমান সামাল দিয়ে বললে, আপনাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, এখানে আমরা সবাই বন্ধু-বান্ধব; নিজেরা নিজেরাই আর কি, নিছক গল্প-গুজব!
ঠিক আছে ঠিক আছে, গল্প করুন আপনারা! কাউন্টারে পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল উভয়ে।
লেব্বারা! নুরুদ্দিন দরোজার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, কি বুঝলি কি?
রহমান বললে, এবার শালার বড় রকমের একটা কিছু ঘটবেই। সারা দেশটা যেন অধীর আগ্রহে গাল বাড়িয়ে রেখেছে–
কেন থাপ্পড় খাওয়ার জন্যে? খোকা বললে।
ঠিক তাই।
তাহলে আর লাভটা কি হলো?
লাভ আছে, লাভ আছে–উল্লসিত হয়ে রহমান বললে, থাপ্পড়টা হবে কি ব্যাপার জানিস? বারুদের কারখানায় ফস্ করে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দেয়ার মতো। তারপরই যাকে বলে ঘাত প্রতিঘাতের ব্যাপার। সংগ্রাম। এতোদিন তো শুধু স্লোগান আর চিৎকারের খোসার মধ্যে বাদামের মতো দেখেছিস সংগ্রামকে, এবার দেখবি তার সত্যিকার সর্বগ্রাসী রাক্ষসমূর্তি। রক্তের বদলে রক্ত, সেই রক্ত হবে স্বাধীনতা!
মওলা ভাসা ভাসা চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে বললে, সবকিছু বন্যার তোড়ে হাতিয়া সন্দ্বীপের মতো ভেসে যাবে, আমাদের অনেকেই হয়তো থাকবে না–
ভালোই হবে–নুরুদ্দিন রগড় করে বললে, খামোকা দালালি ফালালির ধুয়ো তুলে তোকে জ্বালাতন করার লোকও অনেক কমে যাবে। তখন ধুমসে তোদের ওই টিভিতে স্তাড়ামোশে স্তাড়ামোশে করে দিলান্দে সওদে করবি!
আমি নিজেও তো চেঁসে যেতে পারি? প্রোগ্রাম প্রডিউসার মরে না, তোরা মরে গেলে টিভি চালাবে কারা? দালালির ট্রাডিশনটা কন্টিন করতে হবে না? মাঝে মাঝে এমন গোলালু মার্কা কথা বলিস, ভ!
নতুন একটা প্যাকেটের মুখ খুলে সকলের দিকে ধরে খোকা, তারপর আয়েশ করে নিজেও একটা ধরায়।
রহমান বললে, তুই কিছু বল, নুরুদ্দিনটা কেমন ছটফট করছে দেখছিস না!
খোকা বললে, লজিং-এ থেকে মা-মেয়ে দুজনেরই জয়ঢাক মার্কা পেট বানিয়ে ফেলেছে বেচারা, তিন্তিড়ীয় চিন্তায় ওর এখন মাথার ঘায়ে কুকুরপাগল অবস্থা, কোনো মানে হয় না ওকে ঘাঁটানোর!
নুরুদ্দিন ক্ষেপে উঠে বললে, তোর শালা মুখের কোনো ট্যাকসো নেই, একটা ডাস্টবিন!
খোকা ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হলেও নিজেকে সামলে নেয় পরক্ষণেই। সে সংযত কণ্ঠেই বললে, বাজারে জোর গুজব, তাই বললাম
নুরুদ্দিন বললে, ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে!
রহমান বললে, আগে তো পকেটে গুচ্ছের হেঁড়া ন্যাকড়া আর ঢিল ভরে রাখতিস, এখনো চলে ওসব?