কার যে কি ঘটবে! সাংঘাতিক একটা কিছু হয়ে যেতে পারে কালকের মিটিং-এ! খুব চিন্তিত মুখে মুরাদ বললে, বলা নেই কওয়া নেই আচমকা কামান দেগে জেনারেল ডায়ারের মতো মানুষ মারতে পারে টিক্কা খান। শালারা মাল যা এক একখানা। ঘটে অন্য কিছু থাকুক আর নাই থাকুক একটা ব্যাপারে মালগুলোর বেজায় মিল, সব ব্যাটার শুয়োরের গো! আমি চলি!
চলি মানে? খোকা ওর হাত চেপে ধরলো।
এই মিছিলের সঙ্গেই চলে যাই বরং, হাঁটার কষ্টটা টের পাওয়া যাবে না। একটু থেমে বিচিত্র হেসে মুরাদ বললে, আর কিছু সঙ্কলনেরও সদ্গতি হবে এই সুযোগে। ভিতরে যাই থাকুক ঝোঁকের মাথায় ঝটাঝট কিনে নেবে অনেকে–
তুই একটা চিটার! দেশপ্রেমিকরা সবাই যদি তোর মতো চান্স মোহাম্মদ হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত সবাইকে মুলো চুষতে হবে!
তোর কথা আগে বলেছি–বেরিয়ে যেতে যেতে মুরাদ বললে, তুই খোকাগাছ শিকড়সুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়ে যাবি, আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবি না, করাতের টানে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তোর গুড়ি, তোর সব পাতা শুকিয়ে ঝরে যাবে, সামনে ঝড়!
০৪. খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু
খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু।
রেসকোর্সের মিটিং-এর পর থেকে অর্ধেক খালি হয়ে গিয়েছে ঢাকা শহর। অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে দাবানলের মতো গ্রাম-গ্রামান্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামাঞ্চলের দিকে সরে যাচেছ ভীত-সন্ত্রস্ত শহরবাসীরা, পালাচেছ। গোটা দেশের একটি বিশাল চাকা মেঘহীন আকাশের মস্ত খিলানের গায়ে কাত হয়ে পড়ে আছে।
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রেক্সে ঢুঁ মারলো খোকা।
পরিচিত বন্ধুদের বিশেষ কাউকে দেখতে পেল না। এক কোণে রহমান নুরুদ্দিন আর মওলা টেবিলের উপর দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এক বিঘত প্রমাণ একটি প্রচারপত্র ফেলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে আছে। চেয়ার টেনে খোকাও ভিড়ে গেল।
কাগজটা একটা গোপন নির্দেশনামা। শত্রুর, অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর রক্তলোভী কুত্তাদের সম্ভাব্য আক্রমণ শুরু হলে কিভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, আক্রমণ ও আত্মরক্ষা, সংক্ষেপে বোঝানো হয়েছে এইসব। নারী ও পুরুষ–সঙ্কটকালে কার কি কর্তব্য হবে পৃথক পৃথকভাবে তার বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
একটা মাছের বাজার; টেবিল চাপড়ানি, কাচ স্টেনলেস স্টিল আর চীনেমাটির একটানা টুংটাং-ঠুংঠাং এবং হোহো, সব মিলে একটা জ্যাজ, গমগম করছে হলরম। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার সম্ভাবনা আছে কি নেই, অসহযোগ আন্দোলনের শেষ কোথায়, পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন, এইসব নিয়ে ফাটাফাটি তুল-কালাম চলছে সমানে।
আক্রান্ত হবার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল–ইস্তাহার থেকে চোখ তুলে খোকা বললে, কিন্তু প্রত্যাঘাতের ব্যাপারটা কিভাবে হবে শুনি! খালি হাতে, না পায়খানা ঘরের ঝাড় দিয়ে?
সেকথা পরে হবে–নুরুদ্দিন ওর দিকে কাত হয়ে বললে, ওই পায়খানা ঘরের ঝাড়টা তুই পেলি কোথায়? ওটা তো শালা মুরাদের পৈতৃক সম্পত্তি, কদিন থেকে সমানে ওটা দিয়ে রেক্স ঝাড় দিয়ে যাচ্ছে!
মুরাদ আসে নি আজ?
হয়তো এসেছিলো, আমাদের সঙ্গে দেখা হয় নি। নাও আসতে পারে; খুব একচোট হয়ে গেছে কাল, হাতাহাতি পর্যন্ত!
কার সঙ্গে?
কার সঙ্গেই-বা নয়! নুরুদ্দিন হাসতে হাসতে বললে, আমার সঙ্গে মুরাদের, মওলার সঙ্গে রহমানের, শেষে কতোগুলো অচেনা হঠাৎ দেশপ্রেমিকের সঙ্গে এক মুরাদ ছাড়া আর সকলের। যাকে বলে ফাটাফাটি।
সাংঘাতিক ব্যাপার!
রহমান বললে, এটা তো এখন নৈমিত্তিক ব্যাপারে এসে দাঁড়িয়েছে। তুই তো আর এ পথ মাড়াস না, জানবি কি করে। আড়ালে আড়ালে করছিস কি, গোপনে ট্রেনিং নাকি?
কিছুই না—
বিশ্বাস হয় না–মাথা নেড়ে রহমান বললে, এটা এমনই একটা সময় যাচ্ছে যা আমাদের জীবনে আর কখনো আসে নি, হয়তো আর আসবেও না। কিছু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এখন। নির্ঘাৎ তলে তলে বোমা বানাচ্ছিস তুই!
নুরুদ্দিন বাধা দিয়ে বললে, তুই যেমন, বোমা না ঘণ্টা! দেখছিস না কেমন গরুচোর গরুচোর চেহারা হয়েছে কুটুকুমারের। দেদার মাগী চটকে বেড়াচ্ছে ফ্রি স্টাইলে; ঠাউরে দ্যাখ, কেমন ফ্যাকাশে মেরে গেছে! লোপাট-বিজ্ঞানের আইনস্টাইন শালা, নে নে আরেক রাউন্ড চায়ের কথা বলে দে!
চায়ের ফরমাশ দিয়ে রহমান নুরুদ্দিনের দিকে একটা সিগ্রেট তাক করে আলতোভাবে ছুড়ে দিলো। বললে, তুই তো আর বিপ্লবীদের দেখিস নি, তুই চিনবি কেমন করে। ভিতরে ভিতরে নিশ্চয়ই ও একটা কিছু নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। আর উপরে উপরে দেখে এসব আন্দাজ করাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। এই তো তিন-চারদিন আগে, আমার ছোট ভাইয়ের এক বন্ধু–স্কুল ফাইনাল দেবে ছোঁড়া, বললে লাগবে নাকি আপনার–
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নুরুদ্দিন আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললে, ওই অতটুকু ফচকে ছোঁড়া ওই কথা বলতে পারলে, সর্বনাশ!
আবে শালা, মাগী না মাগী না! চিরকালই তো ফকিরনি হাঁটকে-চটকে বেড়ালি, ওটা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না কেন? পিস্তল, পিস্তল, হাতে তৈরি পিস্তল! পকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিলো, বললে, লাগলে রেখে দিন, এখন আমরা দিনে দুটো করে বানাচ্ছি, কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিদিন বিশটার প্রডাকশন হবে। বললাম কাজ হয়, বিচিত্র হেসে আমার হাতে একটা গুলি দিয়ে বললে, আপাতত একটা চারপেয়ে কুত্তা দিয়েই পরখ করে দেখুন!