কেন তোর বোনের প্রসঙ্গ উঠেছে বলে?
তোর যা খুশি বলে যা, এসব যখন তোর ভালো লাগছে। আমি বাধা দেয়ার কে?
কেন ড্যাফোডিলে বসে বিয়ার গিলতে গিলতে হাউ হাউ করে আমার কাছে এসব কাঁদুনি গাইবার সময় তো খারাপ লাগে নি! নাকি বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছিলি সেদিন?
বাজে কথা রাখ! সিগ্রেট ধরিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে বসলো মুরাদ, তেমন কিছুই ঘটে নি এই রকমের একটা ভঙ্গি করে সে বললে, দেশ বলতে আমি কি বুঝি তাই জানতে চাস তুই, বলছি শোন! কখনো বন উপবন, খাল-বিল, নদ-নদী, পশু-পাখি, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-মানুষ রাজ্যের যাবতীয় জিনিস নিয়ে যে ভৌগোলিক সীমা, তাই হলো দেশ। এক্ষেত্রে পদ্মার ইলিশ কিংবা মাঠের একটা ঘাসফড়িং সুন্দরবনের একটা চিতল হরিণ কিংবা মানিকছড়ি, পাতাছড়ি, হিমছড়ির মোটা মোটা শিশির বিন্দু কোনো কিছুই বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই। কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। এমন কি স্মৃতি, অর্থাৎ অতীতে এই সীমার আওতায় যা ছিলো তাও কখনো মহাস্থানগড় হয়ে কখনো শালবন বিহার হয়ে দেশ শব্দটির মধ্যে। গ্রথিত হয়ে যায়।
থামলি কেন, চালা–পা লম্বা করে দিলো খোকা।
কিছুক্ষণের জন্যে থেমে, সিগ্রেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া উদ্ভগরণ করে কুণ্ডলির ভিতর থেকে গলা তুলে, আমি তোমাকে বধ করতে চাই না। আমি তোমাকে বাধ্য করবো শুনতে–এই রকম একটা ভঙ্গিতে পুনরায় শুরু করে মুরাদ, আবার কখনো লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সমষ্টিবদ্ধ মানুষ মিলেমিশে এমনভাবে পৃথিবীর একটি পৃষ্ঠদেশ তৈরি করে যে দেশ শব্দটির রোমান্টিকতা পদপিষ্ট হবার ভয়ে সমষ্টির ওই লৌহবন্ধনীর ভিতর প্রবিষ্ট হয়ে ইচ্ছেমতো হারিয়ে যায়। আর তখন, এমন একটা মূর্তিমান অবস্থার দরুন পদ্মার ইলিশ, ইস্টিমার, পুরানো পল্টনের বুড়ো অশথ গাছ, আলস্যকুঞ্জ, মায়াবন, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। শারদ আকাশ, বিনম্র কুঞ্জলতা, দিঘির পাড়ের বিলোল বিকেল, কালো কুচকুচে নৌকোর মতো বেদেনীর তীক্ষ্ণ শরীর, কিছুই আর মনে থাকে না তখন। অথচ এইসব যে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় তাও নয়—
থামলি কেন চালা–পা লম্বা করে দিলো খোকা।
খোকা নীরবে শুনছিলো। তার ঘাড়গোঁজা মূর্তি দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো মুরাদ খাঁচায় পুরে খোঁচা দিলেও টু শব্দটি করবে না সে এখন। খোকার এই ধরনের নাটুকেপনাময় মতিগতির সঙ্গে তার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে।
পদপিষ্ট হবার ভয়ে কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো খোকা। নিছক খুশি করার জন্যে বলা, নাকি অগোচরে ঠোঁট গলে টুপ করে ঝরে পড়েছে! হয়তো ঘোলাটে পরিস্থিতির পাগলা ঘোড়ার ঘাড় অন্যদিকে ফেরাবার লাগাম হিসেবেই অঙ্ক কষে ব্যবহার করলো মুরাদ কথাটা। কিন্তু এতো প্যাচের ভিতর যাবার কথা নয় মুরাদের; সৎসাহস আছে ওর, খোকা জানে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে লতা-গুল্ম, ফল-ফুল, জলবায়ু, জন্তু-জানোয়ার মানুষ সবকিছুর এক আবশ্যিক সমীকরণ হলো দেশ, যা প্রতিনিয়তই পর্যায়ক্রমে এক একটি চূড়ান্ত বাস্তব অবস্থার ভিতর দিয়ে অনিবার্যভাবেই ছুটে চলেছে মহাকাল তথা ধ্রুবের দিকে–
খোকার দিকে তাকালো মুরাদ। তার চোখমুখের ঘুটঘুটে সেই মেঘটা সম্পূর্ণ বিদূরিত এখন; রুগ্ন অপ্রকৃতিস্থতা কেটে গিয়ে আলো ঝলমল করছে।
একটু আগেই কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে ঘরের ভিতরে নাটকের যে তুলকালাম দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো দুজনের কারো মুখ দেখেই এখন তা অনুমান করা শক্ত।
ভুল বলেছি কিছু?
কি জানি! গা ছেড়ে দিয়ে জবাব দিলো খোকা।
বুঝতে পারছিস তো, দেশ কতোগুলো অবস্থারও নাম–
বুঝতে পারছি–খোকা হেসে বললে–তুই কবিতা লিখিস খিস্তির ভাষায়, আর কথা বলিস কেতাবী ভাষায়, ব্যাপারটা কিন্তু অদ্ভুত!
মুরাদ সংযম বজায় রেখেই বললে, তোর সমস্যাটা কি আমি তা জানি। তোর সমস্যা হলো দেশ আগে না মানুষ আগে; দেশ বড় না মানুষ বড়। আসলে মানুষ নিয়েই যে দেশ এই সহজ সরল সমাধানটা তোর মগজে ঢোকে না, কেননা তোর ধড়ের উপর যে কাঁধ, কাঁধের উপর যে মাথা, তা একটা নয় গোছা গোছা। একটার জায়গায় দশটা মাথা হলে সে আর মানুষ থাকে না, সে হয় গাছ। গাছের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে কোনো লাভ নেই!
বাদানুবাদ হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতো, কিন্তু বাইরে দাপাদাপি আর হৈ-হল্লার শব্দ পেয়ে মুখ বন্ধ করে উভয়েই উৎকীর্ণ হয়ে রইলো সেদিকে। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, এইসব কানে আসে। একটা বিক্ষুব্ধ মিছিল দারুণ চিৎকারে দিগ্বিদিক তোলপাড় করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেবো দেবো দেবো দেবো–রক্ত রক্ত রক্ত দেবো, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত; দ্রুত চেহারা বদলে যাচ্ছে শ্লোগানের।
হঠাৎ ফটাশ করে একটা শব্দ হলো।
কি ব্যাপার?
খোকা আর মুরাদ উভয়েই ছুটলো বারান্দায়। একটা চলন্ত রিকশায় মাইক বসানো ছিলো, টায়ার ফাটলো সেটার।
খোকা বললে, বুকটা একেবারে ধড়াশ করে উঠেছিলো!
আমি তো ভেবেছিলাম মলোটভ ককটেল–মুরাদ উৎসাহিত হয়ে বললে, গভর্নর হাউসের গেটের কাছে কালই তো ছুড়েছিলো দুটো।
মিছিলের কিছু লোক রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের দুএকটিতে কাঠবিড়ালীর মতো তরতরিয়ে উঠে পড়েছিলো এক ফাঁকে, ডাল ভেঙে ঝুপঝাপ করে নামিয়ে দিচ্ছিলো তারা। প্রথমে হুটোপুটি, তারপর কাড়াকাড়ি; অল্পক্ষণের মধ্যে প্রায় ন্যাড়ামুড়া দশা দাঁড়ালো গাছগুলোর। বিজয়কেতনের মতো ডাল গুলো খাড়া করে মিছিলের অগ্রভাগে ছুটলো আবার।