মুরাদ বললে, অনেক সময় আসাদের জন্যে আমার নিজেরও নানান কথা মনে হয়; কষ্ট দেয় ওর স্মৃতি। অন্যদের চেয়ে আমাদের কষ্টটা বোধহয় একটু বেশিই। কিন্তু কেন জানিস? ও আমাদের খুব কাছের একজন ছিলো বলে, চিনতাম বলে, জানতাম বলে। আসাদ ছিলো আমাদের কাছে বাতাসের ঝাপটার মতো হঠাৎ দেখা পাওয়া বন্ধু; এই জন্যেই কষ্টটা। অত্যন্ত ব্যক্তিগত এ কষ্ট। যারা তাকে চিনতো না বা যাদের সঙ্গে তার কখনো পরিচয় ছিলো না, তাদের কাছ থেকেও কি তুই এটা আশা করিস? যদি করিস, তাহলে সেটা নিছক পাগলের পাগলামি। চোখটা নিজের দিক থেকে ফিরিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থের মাপকাঠিতে ফেলার চেষ্টা কর, দেখবি আজ আর এটা নিছক একটা নাম নয়, ঝকঝকে সোনার তরোয়ালের একটা প্রতীক, বিশাল দেশের ওপর স্থির বিদ্যুতের মতো যা ঝুলে রয়েছে। এভাবে দেখতে পারলেই বুঝবি তোর ওই বন্ধুর জন্যে শোক হা-হুতাশ তরতর করে একেবারে পানসে হয়ে গিয়েছে। দেশের কষ্টিপাথরে যদি এভাবে সবকিছু ঘষে নেবার চেষ্টা করিস তাহলে দেখবি আমাদের এইসব ব্যক্তিগত শোক আর কিছু নয়, এক ধরনের গোপন সুখ, আর সুখ বলেই দিনের পর দিন এমনভাবে তা বুকের ভিতর লালন করে চলি। কিংবা ধর ঠিক তাও নয়; ওটা একটা শোকই। শোক হলেও ফ্লু কিংবা চোখ ওঠার চেয়ে, কিংবা টনসিলের ব্যামোর চেয়ে তেমন কোনো মারাত্মক কিছু নয়।
ডাকাতের মতো কথা বলছিস! অনেক বদলে গেছিস কদিনে, জঘন্য!
আমি বলে দিলাম, তুই দেখে নিস, তোর কপালে ঢের বিপদ আছে খোকা! তুই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখিস নি। দেশ হয়তো ক্ষমা করে, কিন্তু সময়, ভ্যাট!
দেশ দেশ করে চাষার মতো অমন চিত্তার জুড়েছিস কেন? দেশ বলতে কি বুঝিস তুই? একটা আধপাতা বয়সের ছোকরা, কতোটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর? কবিতা লেখার নামে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিস পাঁচ বছর; যখন দেখছিস কিছু হচ্ছে না তখন ষাঁড়ের মতো গায়ের জোর ফলিয়ে বলছিস এক্সপেরিমেন্টাল। ডিপার্টমেন্টাল হেডদের মোট বয়ে বয়ে নাড়ু বাবুটি সেজে কোনো রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিস, কিন্তু ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। নিজের বেকারত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এখন হঠাৎ দেশ দেশ করে পাগলা হয়ে উঠেছিস, আমাদের ময়নার বাপ যেমনভাবে বলে জয়বাংলা কায়েম হলেই আর কাজ করাতে হবে না তার মেয়েকে! এটা আর কিছু নয়, ক্লাস পাবার জন্যে হেডস্যারদের ঝকামুটে সাজা যেমন, বিজ্ঞাপনের টাকা মারার জন্যে সঙ্কলন বের করা যেমন, ঠিক তেমনি একটা কিছু! দেশের তুই কি বুঝিস?
মুরাদ ফিরে এসে বসলো। বসার সময় হাতের বইগুলো ডিভানের ওপর ছুড়ে দিলো; বই ছুড়ে ডিভানটাকে সজোরে মারলো সে। তারপর আচমকা সেন্টার টেবিলে দুম করে প্রচণ্ড কিল বসিয়ে বললে, তুই একটা ইতর, জঘন্য তোর মন! কিসের জোরে কোন্ অধিকারে এতো সহজ তুই এসব কথা বলতে পারিস?
ড়ের মতো চিৎকার করবি না। এটা রেক্স নয়, ভদ্রলোকের বাড়ি! আমি চিৎকার করছি, না চিৎকার করছিস তুই? তুই একটা বদ্ধোন্মাদ!
দাদা!
দরোজার ভারি পর্দার গা ধরে রঞ্জু এসে দাঁড়িয়েছে, খোকা দেখতে পেল। বললে, ও কিছু না, তুই ভিতরে যা—
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সে আবার আগের জায়গাতেই এসে বসলো। বললে, তোর সম্পর্কে কতগুলো বাজেকথা উচ্চারণ করতে হয়েছে, এজন্যে দুঃখিত। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমি কারো চোখ রাঙানোর পরোয়া করি না। অধিকার আবার কিসের, সাহস লাগে নাকি এতে?
মুরাদ ততোক্ষণে বন্য পশুর মতো হিংস্র উত্তেজনাকে ঝেড়ে ফেলে অনেকটা সংযত হয়ে এসেছে। সে কতকটা সহজ হওয়ার অভিপ্রায়েই আহত কণ্ঠে বললে, আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে আসি নি–
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, কিন্তু দরকার হলে মারামারিও তুই করতে পারিস!
তোর আত্মম্ভরিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তুই কি ভাবছিস না ভাবছিস তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি শুধু গোটা সমস্যাকে দুজনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে দেখতে চাই নি, যেটা তুই চাস। কথা হচ্ছিলো দেশ নিয়ে; তার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিলি তুই। নিছক মাতলামি ছাড়া আর কি বলবো একে! দেশ বলতে তোদের ধানমণ্ডির এই বাড়ি নয়, যা ঘুসের পয়সায় তোর বাবা তৈরি করেছে। দেশ মানে খান। সাহেবদের দালালি নয়। দেশ মানে ভক্ত কুকুরের মতো প্রভুদের পা চাটা নয়। এই যে হারামির পয়সায় থরে থরে সাজানো তোর ঘর, চারপাশের রাশি রাশি বই, আলস্য আরাম ঘুম, দেশের চেহারাটা ঠিক এর উল্টোটাই!
খোকা মরিয়া হয়ে বললে, তুই তাহলে নিশ্চয়ই একথা বোঝাতে চাচ্ছিস আমাকে, দেশ মানে তোর বাবার রেশন শপের যাবতীয় সেদ্ধ চাল বাজারে ব্ল্যাক করে গম আর আতপ চাল গেলানো। দেশ মানে তোর ম্যাট্রিক ফেল চোগা-চাপকান চাপানো বড় ভাইয়ের ফোরকানি কেতাব চড়াদামে বি, এন, আর-এর কাছে গচানো। দেশ মানে তোর বড়বোনের জীবন বীমার দালালি করা, ব্ল্যাকডগ গিলে চুর হয়ে লাল নীল-সাদা-কালো টয়োটা-ইম্পালায় মাঝরাতে ঘরে ফেরা। ঠিক আছে। আমি মেনে নিচ্ছি। আর এই সঙ্গে এও মেনে নিচ্ছি এই দেশটা একা তোর, আমি কেউ নই, হতে পারি না এই দেশের। দেশ বলতে যদি এই সবই হয় তাহলে দেশদ্রোহী হতেও রাজি আছি আমি।
এগুলো কোনো তর্কই নয়, নোংরা কাদা মাখামাখি। এর কোনো মানে হয় না–অপেক্ষাকৃত ঝিমিয়ে পড়ে মুরাদ, নিষ্প্রভ হয়ে আসে।