তার মানে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের দিকেই মোড় নিচ্ছে সবকিছু, এই তো বলতে চাস?
আমার তো তাই মনে হয়। এই শালার রাসপুটিনের চেহারা মার্কা বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড় দেখলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়; একটা সাংঘাতিক কিছুর আচ করতে না পারলে ব্যাটারা এমনভাবে চাক বাঁধতো না ঢাকা শহরে। টিক্কা খানকে পাঠানোর ব্যাপারটাও যে নিছক একটা ব্লাফ আমি তা মনে করি না। পুরোদমে একটা ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে, দেখা যাক কি হয় আগামীকাল!
রেসকোর্সের মিটিংয়ের কথা বলছিস?
হ্যাঁ। সবাই কানাঘুষো করছে কালকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। বেশ লাগছে যাই বলিস। জীবনে এই রকমেরই উত্তেজনা চাই! স্বাধীনতা-টাধিনতা বুঝি না, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি দেশটা একটা বৈপ্লবিক পরিণতির দিকে লেজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে।
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিস তুই?
পরিষ্কার–
ধর বেধড়ক মার দিয়ে যদি সবকিছু আবার ঠাণ্ডা করে দেয়, তখন?
একটু ভেবে নিয়ে মুরাদ বললে, এখন যে পরিস্থিতি তাতে সেটাই স্বাভাবিক। যতই ট্রেনিং নিক, কুচকাওয়াজ করুক, দেশের লোকের হাতে আছেটা কি? বাঁশের লাঠি আর পায়খানা ঘরের ঝাড়. ব্যাস্! এই কিছু না থাকাটাই মারমুখী হতে প্রলুব্ধ করবে সামরিক শক্তিকে, আর সত্যি কথা বলতে কি এই মারটাই আমাদের ভয়ঙ্কর রকম দরকার। চিন্তা করে দেখ, সামুদ্রিক বান আর ঝড়-ঝাপটায় যেখানে এক কথায় ঝট করে পনেরো-বিশ লাখ লোক গরু-ছাগলের মতো বেঘোরে মারা পড়ে সেখানে দেশের আমূল পরিবর্তনের খাতিরে দুদশ হাজার লোকের আত্মাহুতি তেমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। মোদ্দা কথা, ওরা যদি ভুল করে সামরিক শক্তি প্রয়োগের টিকাই বড় করে দেখে থাকে তাহলে বিপ্লবের জন্যে এটাই হবে সোনায় সোহাগা; তখন কোন্ শালা আর ঠেকিয়ে রাখে বিপ্লব। খ্যাংরাকাঠি আর মচকানো বংশদণ্ড ফেলে ঠিক তখনই হবে সশস্ত্র সংঘর্ষ। চেগুয়েভারার মতো ধরে নিতে পারিস বিপ্লবের জন্যে তখন আর মাথা কুটে মরতে হবে না আমাদের, বিপ্লব নিজেই কলকাঠি নেড়ে দুদ্দাড় করে টেনে নিয়ে যাবে মানুষকে। সামরিক শক্তি প্রয়োগ হবে সব কথার শেষ কথা, মানে নির্লজ্জ শেষ চেষ্টা, মরণ কামড়। সেটা যদি কোনোক্রমে একটু চিড় খায়, তাহলে ব্যাস্, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, গানের বই গানের বই গানের বই–খোকা দাঁত দিয়ে বুড়ো আঙুলের নখ কাটতে লাগলো কুট কুট করে। অসম্ভব দুশ্চিন্তাকাতর মনে হয় তাকে। অকূল পাথারে ভাসছে, থৈ পাচ্ছে না।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুরাদ বললে, এই চান্সে আমি কি করেছি জানিস, আড়াইখানা কবিতার পত্রিকায় হাত দিয়েছি। এইবার সব লীশা হিজড়েগুলোর পিলে ফাটিয়ে দেবো। যা একখানা মাল ছাড়বো না, দেখে নিস! একটা তো বেরিয়েই গেছে–
লীশা কি রে?
শালী থেকে লী, শালা থেকে শা, বুঝলে চাঁদ?
তুই এখনো সেই আগের মতো ঈশ্বর অন্ধকার চিৎকার কবোষ্ণ টবোষ্ণ চালাচ্ছিস নাকি?
তোর শালা সেই পাঁচ বছর আগেকার কথা তুলে খোঁচা দেওয়াটা একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে! নিজে শালা এ পর্যন্ত কি এমন হাতি ঘোড়া, বাঘ-ভালুক মেরেছিস শুনি?
মুরাদকে চটে উঠতে দেখে খোকা হেসে ফেললো।
বললে, অমন দাঁতমুখ সিটকে হাত-পা ছুড়িস না, তোকে উল্লুকের মতো দেখায়! আমার তো বারোটা বেজেই গেছে, এ আর নতুন কথা কি–
মুরাদ বললে, বাজে কথা রাখ, রেসকোর্সে যাচ্ছিস তো কাল?
কালকের কথা কাল হবে, তুই কি এখন উঠছিস?
যেতে হবে না? চোখ নামিয়ে মুরাদ বললে, তোর কি, তুই শালা দিনের পর দিন ঢালাও বিছানায় বুদ্ধের শয়ান হয়ে থাকবি, আর পায়দল মেরে মেরে অন্যেরা তোর চেহারা মুবারক দেখে যাবে, আছিস বেশ! যাচ্ছিস তো? প্রত্যেকটা দিন এখন ইতিহাসের এক একটি পাতা; আমরা এক একজন এক একটা সাক্ষী হয়ে থাকবো। চলে আয় রেক্সে, এক সঙ্গে দল বেঁধে বের হওয়া যাবে।
চেষ্টা করে দেখবো।
দিন দিন তুই শালার একটা কুনোব্যাঙ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাচ্ছিস!
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো মুরাদ, তারপর কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললে, দোহাই তোর, কালকে আয়–
খোকাকে খুব অসহায় মনে হয় এই সময়। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু ছুরির মতো কাটছে তাকে, সুস্থির হতে পারছে না কিছুতেই; হাতের মুঠোয় এমন একটা কিছু চায় খুব ধারেকাছে যা নেই, কিংবা কোনোদিন আর তা পাওয়া যাবে না।
জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। রাস্তায় মিছিল; স্লোগান ফেটে পড়ছে, রক্ত চাই রক্ত চাই! দুপুরের ঝিলমিলে রোদ, বাতাস এবং যাবতীয় নিঃশব্দ চারুময়তা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। জ্বরাক্রান্ত সময়ের গা থেকে ভাপ উঠছে, ঝাঝালো তাতানো দস্যুর মতো আকাশ রোষ কষায়িত নেত্রে অপলক চেয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে ছুড়ে মারবে ঝনঝনে থালা, খোকা তার নিজের ভিতরে একটা অদ্ভুত ধরনের ভাঙন অনুভব করে।
আসাদের কথা তোর মনে আছে মুরাদ?
দূরাগত ধ্বনির মতো মুরাদের কানে বাজলো কথাটা। বেরুতে গিয়ে সে আবার ঘুরে দাঁড়ালো। বললে, মনে থাকবে না কেন, সেই যে–
আপদ বালাই উল্টো হাঁটে
দুরমুশ খাঁ ঠোকে জুতো,
আসাদ শুধু ম্যাজিক দেখায়–
ফুস-মন্তর দেখলি তো?
খোকা বললে, আমি ভাবতেই পারি না আসাদ নেই। খুব কষ্ট হয় আমার। এই যে ও নেই, তার জন্যে কার কি এমন ক্ষতি হয়েছে, কি এমন যাচ্ছে আসছে? নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই–এসব একেবারেই বানোয়াট কথা, কানে খুব ভালো শোনায়, এইটুকুই! অন্যকে মরতে উৎসাহিত করাটা পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে সহজে একটা কাজ। মরণ রে, তুহু মম শ্যাম সমান, শ্যাম সমানই যদি হবে তবে নাভিশ্বাস ওঠার পর কবরেজ-বদ্যি করার কি দরকারটা এমন? নিছক একটা ধাপ্পা, একটা জঘন্য প্রচারণা, বাবু বিলাসিতা