কেন, ঠিকে ঝি আর লেবুকে দিয়ে চলবে না?
ঠিকে ঝি তো কদিন থেকে ঝক্কি শুরু করেছে, ও নাকি আর কাজ করবে না, দেশে যাবে। এতোদিন আমরা ফাঁকি দিয়ে ইচ্ছেমতো ঠকিয়েছি ওদের, মানুষ বলে গ্রাহ্যই করি নি, কাজে এলেই প্যান প্যান করে এইসব তোলে–
এক কাজ করা যাক বরং–খোকা হাসতে হাসতে বললে, আয় দুজনে মিলে আমাদের আগা মোহম্মদের কাছে একটা পয়েন্ট পিটিশান করি, কামের লোকের খুব অভাব, তোমার ওই দস্তানাগ গাওয়া কিছু বুগতি-টুগতি এদেশে পাঠাও।
কিছুটা আনমনা হয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে র ঞ বললে, কি সব অলক্ষুণে কাণ্ডকারখানা শুরু হয়েছে বলতো, একরত্তিও ভালো লাগছে।
আমার! তোদের কলেজের মেয়েরা পাকাঠির গোছা হাতে নিয়ে সমানে রাস্তায় রাস্তায় ডান-বাম ডান-বাম করে বেড়াচ্ছে, খবর রাখিস?
দুর, আমার ওসব ভালো লাগে না!
কলেজে যে ফাটাফাটি চলছে রঞ্জু তা জানে। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে; ক্লাস হয় না, স্রেফ মিটিং আর মিছিল।
যা না, ঘুরে আয়, নিদেনপক্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোকরা তো দেখা হবে–
রঞ্জু বললে, এই একটু আগেই তো পাড়ার কয়েকজন ডাকতে এসেছিলো। ওরা হেঁটে কলেজে গেল। বহু মেয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে!
তোদের আবার ট্রেনিং লাগে নাকি! তোরা তো পেটে থাকতেই হাফেজ বনে যাস!
রঞ্জু বললে, রাইফেল ট্রেনিং রাইফেল ট্রেনিং
কচু হবে ওতে, শালার এটা একটা ফ্যাশন; যা নড়য়ে তোমরা এক একখান, এহ!
রঞ্জু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। বললে, শেষ পর্যন্ত কি হবে বলতো?
কি আবার হবে, হয় দুপাঁচশো লোক মেরে সব ঠাণ্ডা করে দেবে না হয়–
বাধা দিয়ে রঞ্জু অসহিষ্ণু হয়ে বললে, সব মেনে নিলেই তো পারে, শুধু শুধু হই হই রক্তারক্তি করে লাভটা কি?
তুই বরং ঘচাং করে একটা খত ঝেড়ে দে, কাজ হলেও হতে পারে, লোকটা নাকি মেয়েলোকের কথায় ওঠে-বসে।
ঠাট্টা রাখ, একটু বুঝিয়ে বল্ না ছাই! আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার সময় তো মুখ দিয়ে কথার তুবড়ি ছোটে।
রঞ্জুর বিনুনি ধরে একটা টান মেরে খোকা বললে, তুই যা বুঝিস অন্তত সেটুকুও যদি ওদের মগজে ঢুকতো তাহলে তো আর কোনো ল্যাঠাই ছিলো না।
আচ্ছা ধর, শেষ পর্যন্ত যদি কোনোরকম মীমাংসা না হয়?
হবে কে বললে?
ধর হলো না, তখন?
কেন প্লেন বোঝাই বোরখা পরা সৈন্য নামছে রোজ এয়ারপোর্টে শুনিস নি?
বাপি যে কেন আগেই চলে আসছে না!
রাওয়ালপিন্ডির পিন্ডি চটকাবে কে, তুই?
যাই বলিস, চাকরি জিনিসটা এতো বাজে—
এ্যাঁ, পথে এসো বাবা, পথে এসো। সেই জন্যেই তো বেকার বসে আছি।
তুই একটা কুড়ের ডিম, চাকরি কেন, তোকে দিয়ে কিছুই হবে না কখনো।
লম্বা হাই তুলে পটাপট দুটো আঙুল মটকে খোকা আউ আউ করে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, বেশ আছি শালার, কি বল? আহারে, চিরটা কাল যদি এইভাবে আরামসে পিপুফিশু করে কেটে যেতো!
শরীরে ঘুণ ধরতো, উইপোকা ধরতো—
শরীরে উইপোকা না ধরলে কি আর মুনি-ঋষি হওয়া যায় রে, তুই একটা ইপিস্ট, ষাঁড়ের গোবর, গোমুখ্য!
একটু পরেই জয়বাংলা বলে মুরাদ ঘরে ঢুকলো।
রুমাল দিয়ে মুখ মুছে একগ্লাস পানি চেয়ে খেলো সে। বললে, কদিন থেকে হাঁটতে হাঁটতে শালার পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে।
বলিস কি, ফোস্কা আবার কি তোর পা জোড়াই তো ফোস্কা।
তার মানে?
একে বেকার, তায় শালা আবার মাঝে মাঝে কবিতে সঙ্কলন বের করার ঘোড়ারোগ আছে, তোর পা আবার কবে পা ছিলো শুনি?
একটু লাগলো মুরাদের এই কথাটা। খোকার মতোই সে বেকার। তফাতটা শুধু এই, গোটা দুয়েক মাস্টারি করে সে আর চাকরির চেষ্টা তদবিরের জন্যে ঢালাও সুপারিশমামা ছুঁড়ে বেড়ায়।
মুরাদ আলগোছে বললে, বাপের টাকা থাকলে তো ধ্বংস করবো। সে যাক, কি করিস কোথায় থাকিস, প্রায় সারাদিনই আজকাল রেক্সে আড্ডা চলে, একদিনও পাওয়া যায় না তোকে, নাকি সব ছেড়ে-ছুড়ে একেবারে যোগী হয়ে গেলি!
ধরেছিস ঠিকই।
আমি তো ভাবলাম নির্ঘাৎ অসুখ-বিসুখ একটা কিছু বাধিয়ে বসে আছিস, তা না হলে এই সময় কোনো পাগলেও ঘরে বসে থাকে বলে আমার মনে হয় না। এই তো সময় চুটিয়ে আড্ডা মারার। গরম বাজার, অফুরন্ত সময়, স্রেফ চা মারো আর গুলতানি।
ব্যাস্, তাতেই দেশ স্বাধীন? আলবৎ তাই! স্রেফ চায়ের কাপে চুমুক মেরে আর গুলতানি ঝেড়ে স্বাধীনতা নিয়ে আসবো এবার, দেখে নিস। এবারে শালার স্বাধীনতা রোখে কে?
খাতায় নাম লিখিয়েছিস নাকি, যে টোনে কথা বলছিস।
ওসব বুঝি না–মুরাদ চঞ্চল হয়ে বললে, এখানে-ওখানে। বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ উড়তে দেখা যাচ্ছে, এখন পিছনে ফেরার আর কোনো পথ নেই চাঁদ।
সর্বনাশ! তুইও কি ট্রেনিং নিচ্ছিস?
ট্রেনিং? ট্রেনিং আবার কি। নে নে খচড়ামি রেখে চা-টা খাওয়াবি তো। খাওয়া।
যথাসময়েই চা আসবে। অপেক্ষাকৃত বিমর্ষ মুখে খোকা বললে, সত্যি করে বলতো, এইসব হৈহল্লা দা-কুড়ল-লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পায়তারা, এখানে-ওখানে লুটতরাজ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এসব ভালো। লাগছে তোর?
মুরাদের চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে সহসা।
বললে, এটা ঠিক ব্যক্তিগত ভালো লাগালাগির ব্যাপার নয়, তুই ছোট করে দেখছিস বলে তোর কাছে অমন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা সমগ্র দেশকে নিয়ে, একটা গোটা জাতিকে নিয়ে। ঘরের কোণায় বসে তুই কি ভাবলি, কিংবা রেক্সের আড্ডায় বসে নিছক ভাবাবেগের খাতিরে আমি কি বললাম, এইসবে কিছু যাবে আসবে না। তাকিয়ে দেখ সারা দেশটার দিকে; একটা ক্ষুব্ধ বাঘ, থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে তার গর্জন। যে কোনো মুহূর্তে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আজ তো শুনলাম কুমিরার কাছাকাছি দুহাজার সৈন্য এসে পৌঁছেছে, যে-কোনো মুহূর্তে তারা নেমে পড়বে–