সামান্য একটু এগোলেই রাস্তা। কেবল ধুলো আর ধুলো, চারিদিক ধুলোয় অন্ধকার। অল্পক্ষণের মধ্যেই খোকা মিছিল দেখতে পায়, মহা আক্রোশে ফেটে পড়ছে মিছিলের মানুষ।
ঢল নেমেছে রাস্তায়। মানুষের এমন রুদ্রমূর্তি সে আর কখনো দেখে। নি। পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে, দিগ্বিদিক ঝাপসা, অবলুপ্ত; চতুর্দিকে বোমার মতো ফেটে পড়ছে স্লোগান।
এতোক্ষণ পর হুঁশ হয় খোকার, বাড়ি থেকে বের হবার পরপরই মিছিলের স্রোত বয়ে যেতে দেখেছিলো সে, গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো তখনই।
খোকা ছোটা শুরু করে।
প্রতিটি রাজপথই এখন ভয়ানকভাবে পদপিষ্ট। মুহুর্মুহু বজ্র-নির্ঘোষে উপর্যুপরি কেঁপে উঠছে সবকিছু কাছেপিঠে কোথাও কোনো এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি শতবর্ষ পর রুদ্ররোষে উদ্গিরিত হচ্ছে, ভস্মাচ্ছাদনে মুড়ে দিয়েছে চিৎপাত শহরকে; সংহারপিপাসু উত্তুঙ্গ অগ্নিময় লাভাস্রোতে ধীর অথচ প্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসরমান।
মানুষের ভিড় কেটে বেরুতে পারছে না খোকা। বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। আসন্ন ত্রাস তাড়া করছে তাকে; মুহূর্তের সামান্য ব্যবধানে একটা আবশ্যিক প্রতিক্রিয়ায় সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, ভেঙে পড়বে বিচারালয়, ভেঙে পড়বে মিলনায়তন, ভেঙে পড়বে পানশালা, স্টেডিয়াম। এতোদিন তার চোখে যা ছিলো সামান্য মানুষ, এখন তা সংগঠিত অবিচ্ছিন্ন মিছিলে। খোকা শিউরে উঠলো, এতোদিন তার কাছে যা ছিলো দয়িতা যামিনী মদিরার মতো তিন অক্ষরের হাল্কা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়, জনতা!
০৩. পিঠেপিঠি কয়েকটা দিন
পিঠেপিঠি কয়েকটা দিন এইভাবে কাটলো। ঘর থেকে বের হয় নি খোকা। সম্বল বলতে কেবল খবরের কাগজ, অথচ এ জিনিসটা দুচোখে দেখতে পারে না সে, দারণ বিতৃষ্ণা। সাধারণত সে কাগজ পড়ে না, কিন্তু কিছুদিন যাবৎ তাকে পড়তে হচ্ছে।
এ কয়দিনের ভিতর সবকিছু বেজায় রকমের বদলে গিয়েছে। কাগজ হাতে নিলে মনে হয় সদ্য অস্ত্র কারখানা থেকে বারুদ মেখে এসেছে। ছিটেফোঁটা দুর্ঘটনার খবর আসছে যখন-তখন। পরস্পরবিরোধী রাজ্যির যত উড়ো খবরে বাজার সরগরম। কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু অচল; দিনরাত ঘোঁট পাকাচেছ মানুষজন।
মোড়ে মোড়ে জটলা, প্রায় সর্বক্ষণ প্রতিটি রাস্তাতেই বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিটি ময়দানেই জনসভা। সর্বত্র একই কানাকানি, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার উদ্দেশ্য কি, নাকি আসলে সবটাই আগাগোড়া একটা ধাপ্পা; আবার সেই বুটজুতো আর রাইফেলের বাটের গুঁতো!
ক্ষেপে উঠেছে মানুষজন; একটু স্বতন্ত্র এবারের এই ক্ষ্যাপামির চরিত্র। আয়ত্তের বাইরেও চলে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হবে এবার, এইসবে বিশ্বাসী অতি সাধারণ মানুষও। অবাঙালি পজিপতিরা বস্তা বস্তা টাকা পাচার করে ফেলছে, রুই কাতলারা ভাগছে, গা ঢাকা দিয়েছে অনেকেই, একটা কালো পরিণতি ধীরে ধীরে তার ক্ষেত্র তৈরি করছে।
সাত-সকালে ময়নার বাবা এসে এক ঝঞাট বাধালো। সে ড্রাম ফ্যাক্টরির শ্রমিক, রায়পুরের লোক। এখন আর ঢাকা শহর নাকি মোটেই নিরাপদ নয়, ময়নাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে চায়।
খোকা বিরক্ত হয়ে বললে, আমাদের ফেলে বাছাই করে তোমার মেয়েকে কেউ মারতে আসবে না।
লোকটা নাছোড়বান্দা ধরনের। বললে, আপনাদের আবার কিসের ভয়? আপনাদের কেউ মারতে আসবে না। চিরকাল যত গজব সব আমাদের মতো ফুটোকপালে গরিব-দুঃখীদের উপরই; গায়েও আঁচড় লাগবে না আপনাদের
খোকা পষ্টাপষ্টি বলেই ফেললে শেষ পর্যন্ত, ও চলে গেলে অসুবিধে। হবে আমাদের!
ময়নার বাবা বললে, লোকে যা বলাবলি করছে তাতে শহরে থাকা চলে না। পারলে কিছুদিনের জন্যে আপনারাও একদিকে চলে যান। আল্লা করুক, জয়বাংলা যদি হয়েই যায় তাহলে আর মেয়েটাকে ঝিগিরি করায় কে।
খোকার মেজাজ খিচড়ে উঠলো এইসব কথায়। বুঝলো কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না, খামোকা, পাগল ক্ষেপেছে; ময়নার বাবার এমন একরোখা চেহারা এর আগে আর কখনো চোখে পড়ে নি তার। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু ওকে নাড়া দিচ্ছে, খোকা বুঝতে পারে, ফলে বিশ্বাসে যত না জ্বলজ্বলে তার চেয়ে বেশি উদ্ধত এখন লোকটা, ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।
কি রে ময়না যাবি নাকি? ভিতরে গিয়ে সে জিগ্যেস করলো ময়নাকে। বললে, যাবি তো যা, সৎ মায়ের কাছে আগের মতো আরামেই থাকবি!
ময়না বললে, আগে বলে দিয়েছি, যাব না আমি—
তোর মর্জি!
ময়না বললে, আমার জন্যে অত ভাবতে হবে না, বলে দিন।
তাহলে যা, বিদায় করে আয়–
ময়নাকে গররাজি দেখে গালাগাল শুরু করলো লোকটা। বললে, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার? চুল ধরে হিড় হিড় করে টেনে বার করবো এখান থেকে। বড়লোকের বাড়িতে ফ্যানের বাতাস খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে যাওয়া দেখাচ্ছি তোকে, এইবেলা গোছগাছ করে নে, নইলে মেরে তক্তা বানাবো?
মেয়ে নিয়ে যেতে এসেছো, মেয়ে নিয়ে যাবে; বাজে কথা বললে অসুবিধেয় পড়বে বলে দিলাম–খোকা তেড়ে উঠলো।
আমি আমার মেয়েকে বলছি, আপনি গায়ে মাখছেন কেন? ঘোত ঘোত করে উঠলো লোকটা, ওটা একটা কুত্তি, কুত্তিটাকে এইবার চেন দিয়ে বাঁধবো, ওর রস মেরে গুড় করবো
ফোঁস ফোঁস করে কান্না শুরু করলো ময়না।
শেষ পর্যন্ত দুদিন পরে তার যাওয়া সাব্যস্ত হলো।
রঞ্জু মুখ কালো করে বললে, এখন উপায়?
সেলফ-হেল্প!
নিজে তো বলেই খালাস!