খোকা তুমি কিছু বলো—
কি বলবো–স্বপ্নের ভিতর থেকে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলো খোকা; তার গলার স্বর ঘড়ঘড়ে।
কিছু বলার নেই তোমার?
দেয়ালের রঙ ততোক্ষণে অপসৃত; চার দেয়ালের সেই অবিশ্বাস্য আলিঙ্গন শৈথিল্যে ভেঙে পড়েছে, স্বপ্নের ভিতরে যেন এইমাত্র একটি কাক ইলেকট্রিক তারে আটকে গিয়েছে, অজস্র চিৎকার এখন কানের চারপাশে।
আমার নিজের কথা এখনো শেষ হয় নি, ভালো না লাগলে আজ থাক–
ভালো লাগছে, তুমি বলতে থাকো–খোকা চেষ্টা করলো স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়ার, কিন্তু প্রবল বিতৃষ্ণা তার কথাগুলোকে অগোচরে দুমড়ে দিলো।
যেদিন তুমি বললে, আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, না দেখে থাকতে পারো না, সেদিন দুলে উঠলো আমার ভিতরটা, সেকথা তো আগেই বলেছি। সত্যি বলছি, তোমার ওই স্বীকারোক্তিতে আমার মনের সব বাঁধন একেবারে আলগা হয়ে খসে পড়েছিলো। একটা স্রোত এসে ধাক্কা দিচ্ছিলো সেখানে। মনে হচ্ছিলো সেই গোয়ার স্রোতের মুখে আমার ঘরবাড়ি বাগান সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, প্রাণপণে চেষ্টা করেও নিজেকে সামাল দিতে পারবো না। কিন্তু কেন, কেন এমন হলো আমার? বিশ্বাস করবে, আজ থেকে সেই তেরো বছর আগে তোমার রাজীব ভাইও ওই একই কথা বলেছিলো আমাকে, এবং তার যে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তা-তো বুঝতেই পারছো আমাকে এই সংসারে দেখে!
একেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—
একই কথায় যখন তেরো বছর বাদে ঠিক একই প্রতিক্রিয়া হলো আমার, তখন বুঝলাম আমি মোটেই ওর পিছনে পড়ে নেই। সংসার কেন, কোনো কিছুই আমাকে ছোবল দিতে পারে নি। নিজেকে নতুন করে আবার আবিষ্কার করলাম। একটা সোনার প্রদীপ হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিলো দিঘির গভীরে, তুমি আমার সেই রাজকুমার ব্যাঙ, তুলে দিয়েছো তুমি; এখন আর শুধু শুধু ঘর অন্ধকার করে বসে থাকা কেন?
শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ বানিয়ে তবে ছাড়লে, একেই বলে সামরিক শাসনের কুফল! তা থামলে কেন? আরো কিছু?
আজ এই পর্যন্ত—
অর্থাৎ খেল খতম, পয়সা হজম, এই গানের বই গানের বই গানের বই!
কিছুটা আছে আরো। এতোক্ষণ যা যা বললাম এর সবই তোমার রাজীব ভাইয়ের জানা। ও সবই বোঝে, সবই আন্দাজ করতে পারে। আর পারবে না-ই-বা কেন, আজ তেরো বছর এক সঙ্গে ঘর করলাম, হাবা কালা তো আর নয়! তোমার কথা শুনে কি বলেছে জানো? বলেছে, খোকার ভিতরে নিজের অগোচরে আমার অতীতকে খুঁজে বেড়াচ্ছো তুমি, ওটা আর কিছু নয়, আজীবন আমাকে ভালোবেসে যাবার একটা পাগলামি তোমার; শুনে আমি হেসেছি।
হাসবেই তো, অমন হাসির কথায় না হেসে পারা যায়!
চটেছো মনে হচ্ছে?
ছেড়ে দেওয়া গরু যখন পরের ক্ষেতে ধান খাচ্ছে, তখন ক্ষেতটাকে পৈতৃক সম্পত্তি ধরে নিতে পারলে আপদ চুকে যায়। এতো বকতেও পারো। প্রার্থনা করি নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে ফঁাৎ ফোৎ করে এতোক্ষণ যত কথা বললে তার বিন্দু-বিসর্গও যেন আমার বিশ্বাস হয়। মুখ ব্যথা করে না তোমার, এতো কপচাও কি করে? আজ আর আমার ধৈর্য নেই, আমি উঠবো–
অত তড়িঘড়ি করার কি আছে, চা খেয়ে তবে উঠবো।
গুলি মারো! চুলোয় যাক তোমার চা! আমার মাথা দপদপ করছে। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা কোনো একটা সেলুনে যাবো, আধঘণ্টা ধরে শিরমালিশ চালাবো, তারপর অন্য কথা, বাপস!
ঠিক এই সময় হুড়মুড় করে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ঢুকলো রাজীব ভাই; পা থেকে মাথা ধুলায় ধূসর, দুশ্চিন্তাকাতর মুখাবয়ব। খোকা দেখলো, রাজীব ভাইয়ের চোখে জটিল চাঞ্চল্য; মনে হলো ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে গিয়েছে, তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ঘরে এসে পৌঁছেছে।
খোকাকে দেখে হাতের ব্যাগটা রাখতে রাখতে রাজীব ভাই বললে, কতোক্ষণ?
তা অনেকক্ষণ, প্রায় সারাদুপুর–
বলো কি! কথাটা সংক্ষেপে শেষ করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নীলাভাবীর দিকে তাকালো রাজীব ভাই, বললে, তোয়ালে সাবান সব দাও, গোসল করবো, গলার ভিতর পর্যন্ত ধুলোবালি কিচকিচ করছে।
খোকা বিছানা থেকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলে, ব্যাপার কি রাজীব ভাই, এমন হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে?
শহর খুব গরম।
তার মানে?
বাইরে তুমুল গণ্ডগোল!
হঠাৎ?
হঠাৎ নয়, আমি তো জানতাম-ই এই ধরনের একটা কিছু হবে। দুটোর সময় প্রেসিডেন্টের কি এক ছাতার স্পিচ ব্রডকাস্ট হয়েছে, ব্যাস, সারা শহর ফেটে পড়েছে বারুদের মতো। স্টেডিয়ামে চেয়ার ভাঙাভাঙি, দোকানপাট সব দুদ্দাড় করে বন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় কেবলি মানুষ আর মানুষ লাঠিসোটা, লোহার রড, পাইপ, হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সব উন্মত্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সব বন্ধ। গাড়ি-ঘোড়া থেকে হাওয়া-বাতাস, গাছের পাতা পর্যন্ত পড়া বন্ধ। কি বলবো, পথে-ঘাটে হাঁটার উপায় নেই, থৈ-থৈ করছে মানুষ। বাবারে বাবা, এতো মানুষ সব ছিলো কোথায়!
খোকা রসিকতা করে বললে, এখন বুঝলেন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর মালকড়ি কিভাবেই না গুবলেট হয়!
রাজীব ভাই সহজ গলায় বললে, আসলে ওইসব দপ্তরে আমার মতো একজন কনফর্মড বিশেষজ্ঞ দরকার, কি বলো? সে যাক, তুমি কিন্তু আর মোটেও দেরি কোরো না, এখনই বেরিয়ে পড়ো। গাড়ি ঘোড়া তো আর নেই, পায়দলই মারতে হবে। যে-কোনো মুহূর্তে খুন খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যেতে পারে, শহরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
অনেকক্ষণ পর বাড়ির কথা মনে পড়লো খোকার, ছাৎ করে উঠলো বুকের ভিতর। অতোবড় বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে সে।