বাধা দিয়ে খোকা বললে, সিকোয়েন্সগুলো একেবারে সিনেমার মতো!
শুধু এলে বললে ছোট্টো করে বলা হবে, তোমার আবির্ভাব হলো; আমার জীবনে একটা অসাধারণ অভ্যুদয় ঘটলো। অভ্যুদয় কেন বলছি জানো?
নিছক ওজন বাড়াবার জন্যে। দাঁত দিয়ে কুটুস করে একটা নখ কেটে খোকা উত্তর দিলো।
তার মানে?
ওজন? ওজন এক ধরনের গ্যাস।
মানেটা এই, তুমি আমার কথা মোটেই ধরতে পারো নি!
না পারার কি আছে এতে–খোকা বাধা দিয়ে বললে, না পারার কি আছে এমন? সোজা কথা তোমার যেমন দেবা, তেমনি দেবী; আমি তো কোনো ফারাক দেখতে পাইনে। রাজীব ভাই যেমন–গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এস্রাজ থেকে তুমি, শেষে হীরা-জহরৎ, তুমিও তেমনি! প্রথমে শিলনোড়া, শিলনোড়া থেকে মুড়োঝাঁটা, মুড়োঝাঁটা থেকে সুখপাঠ্য বই, শেষে এক্কেবারে মক্ষিরানী!
আমি বলছিলাম তোমার কথা। তোমার রাজীব ভাই যেমন ভাগ্যকে বদলে দেয়ার গ্রহরত্ন নিয়ে ঘরে ঢোকে, তেমনি করে নিয়ে এলো তোমাকে। ঝলঝল করে উঠলো বাড়িটা। কি বিশ্রী, স্তৃপাকার ধুলো আর আবর্জনা ভরা ঘরের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম! সব আবর্জনা দুহাতে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম, তুমি যেন এক অপ্রত্যাশিত দুর্লভ উপহার, এ উপহার যেন আমাকে মানায়, যেন বেমানান না হয় আমার ঘর—
তবে যে এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে বললে মাছমার ছিপ? বাধা দিয়ে জিগ্যেস করলো খোকা।
জ্বালিও না, কথা বলতে দাও! তোমাকে দেখে আমি বদলে গেলাম। সাজ সাজ রব পড়ে গেল ভিতরে। বাঁচবার জন্যে আমি হাবাগোবার মতো দৈব-দুর্বিপাককে আশ্রয় করতে চেয়েছিলাম; তার বদলে বিনা চেষ্টায় বিনা প্ররোচনায় তুমি আমাকে উৎসাহিত করলে ভিতরের প্রাণশক্তিকে যাচাই করার। আমি আমার স্বামীর কথা ভাবলাম। এই প্রশ্ন তুলে মনে মনে যাচেছতাই ক্ষেপে উঠলাম, এখনো ওর যা আছে আমার তা থাকবে না কেন। ঠিক প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রশ্নটা একেবারে নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে। এখনো কি অগাধ আমার ক্ষমতা, কি প্রচণ্ড আমার শক্তি! যতোই বুঝতে পারি ততোই হাততালি দিয়ে উপচে পড়তে থাকি খুশিতে। ইচ্ছে করলেই আমি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি তোমাকে, ডুবিয়ে দিতে পারি কাদায়; আমি চাই সানন্দে তুমি আমার ক্রীতদাস হবে। তোমাকে ঘুঙুরের মতো পায়ে বেঁধে রাজ্যময় নেচে বেড়াতে পারি এখনো। ও যেমন বেঁচে আছে, আমিও মরি নি, বেঁচে আছি আমিও। কি নির্লজ্জ সে উল্লাস, তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না!
হীরার মতো জুলজুল করে জলছিলো নীলাভাবী। খোকা হাবার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে নীলাভাবীর দুচোখ দিয়ে। মাঝখানে দুটি বিন্দুর মতো দুজনকে বসিয়ে অকারণ আনন্দে চারটি দেয়াল যেন হাত ধরাধরি করে শিশুর মতো নেচে নেচে ঘুরপাক খাচ্ছে; দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান। লেসের কাজে মোড়া টিপয়ের ছাউনি দুলছে, দুলছে ফুলদানি, দুলছে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রজনীগন্ধাগুচ্ছ, ট্রানজিস্টার যেন বনবিড়াল, খাড়া করে মৃদু মৃদু নাড়ছে। এরিয়েললেজ; হাওয়া, এতো হাওয়া আসে কোথা থেকে, সমুদ্রের খুব কাছে তারা, কিংবা একটা জাহাজের ভিতর, হাওয়ায় মাছের ফিসফিসানি, হাওয়ার গভীর গোপনে সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে।
এ যাত্রা তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আজ আর দুজনের কাউকে নিয়ে মনের ভিতর কোনো গ্লানি নেই।
খোকা কোনো কথা তুললো না। বসে রইলো নিঃশব্দে।
বিকেলছোঁয়া নিভন্ত দুপুর, সেগুনবাগিচার প্রাচীন হলদে কোঠাবাড়ির বিড়ালের মতো আলস্যময় কোমল কামরা, এক আঁটি নির্দোষ। রজনীগন্ধা, রজনীগন্ধার মতো ধবধবে অঢেল বিছানা, নরোম নিরুদ্বিগ্ন হাওয়া, এবং একটি নারীদেহ যা পরিচিত হলেই মোমের মমি হয়ে যায়, সবকিছু আড়াল করে যাচ্ছে তাকে, আড়াল করে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো নিরলস সহজ অভ্যাসে, স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ভাসা ভাসা মনে হয় খোকার। ঝালরের মতো বিছানার একটা প্রান্ত দুলছে, যেন একটা ভিজে হাওয়ার ঝাপটা, এবং কম্পমান, দুর্বিনীত গ্রীবা তুলে উদ্বেল বিশুদ্ধ রজনীগন্ধাগুচ্ছ থরথর কম্পমান।
ঘুরেফিরে একটা ঝাপসা ছবি, যা দীপ্র পাপবোধের চেয়ে মোহন, তার নিজের দিকে বিবসনা নারীর মতো প্রবলভাবে টানতে লাগলো খোকাকে; ছবিটি ক্রমশই মায়াবিনীর মতো রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতায় :
স্বপ্নের গভীর সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলো খোকা ঘরের চারটি দেয়াল তীব্র–মধুর মরনোলাসে পরম্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ, এক; পরস্পরবিরোধী অমসূণ রঙ আর রেখার অনিবার্য অভিঘাতে–এক। কোথাও হলুদ, কোথাও বেগুনি, কোথাও সবুজ, টুকরো টুকরো, গোছা গোছা; দীর্ঘ অন্বেষণে পরিশ্রান্ত লাল-নীল-কমলার সন্ধানী রেখার প্রপাত। বিপর্যস্ত বিস্রস্ত স্নায়ুর মতোই দেয়ালময় একাকার এবং নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো দাঁতাল গহ্বরের প্রতিভাসে আপতিত উদ্দেশ্যহীনতা আশ্চর্যভাবে পুনঃসংগঠিত। কোথাও লাল এমন প্রবল তা যেন নিজেরই মাংস নিংড়ানো, কোথাও নীল এমন বিশৃঙ্খল যেন তা আকাশ থেকে করাতে কাটা। একপাশে বৃন্তচ্যুত ফলের মতো বিচ্ছিন্ন। স্তন, নির্মম নখরাঘাতে যা ছিন্নভিন্নপ্রায়। সন্নিকটে একজোড়া সুগঠিত উরু, যার সন্ধিতে দক্ষ কারুশিল্পীর চিৎকার খোদিত। এই চিৎকার নিঃসৃত তুমুল রক্তস্রোত যেন নিদারুণ প্রয়োজনেই রহস্য শোভিত অনড় ডলফিনের মতো। শিলাখণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে খুবলে খাওয়া শূন্যতার স্তম্ভেও আকার নিয়েছে, সেখানে এক অনৈসর্গিক নিস্তব্ধতা আপন পক্ষপুটে অচঞ্চল।