পাখার বাতাস গরম হয়ে উঠেছে। বাইরের রোদ একটু একটু করে বিকেলের দিকে গড়াচ্ছে। এক সময় শান্ত হয়ে এলো নীলাভাবী। বললে, তোমার মনটাই আজ খারাপ করে দিলাম। কি আর করবো। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে বলবো এসব, সত্যিই ভিতরে ভিতরে দারুণ হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ভালোই হলো একরকম, বুকের ওপর থেকে পাথরটা খানিক সরে গিয়েছে। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তোমার রাজীব ভাইয়ের; এস্রাজ ম্যাজিক গল্প সবই এখন অন্য এক গল্প হয়ে গিয়েছে, অথচ একদিন শুতে যাবার আগে হাত নিশপিশ করতো মানুষটার, কিছুতেই ঘুম আসতো না, এস্রাজে ছড় বুলানো চাই, মানুষ খুঁজে বেড়াতো গল্প জমাবে বলে। যে অভ্যেসগুলোকে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো অলক্ষ্যে সেইগুলোই ওকে ছেড়ে চলে গেছে। তবু বেচে আছে মানুষটা। টিকে আছে। কিন্তু টিকে আছে কি করে তা জানো? ভালোবাসাটা ওর স্বভাব, এখনো মরে নি সেটা। সব ওকে ছেড়ে গেছে, কিসের একটা ভারে দিন দিন ও ন্যুজ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওর ওই ভালোবাসার স্বভাব এখনো ছেড়ে যায় নি ওকে।
একটু থেমে খোকাকে একবার নিখুঁতভাবে জরিপ করে নিলো নীলাভাবী; তারপর খুব আচ্ছন্নভাবে বললে, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো তো?
কিছু কিছু–খোকার উত্তরে প্রচ্ছন্ন বিরাগ।
এতোসব কথার পর তোমার ঠিক বিশ্বাস হবে কি না জানি না–এস্রাজের চেয়ে, গল্পের চেয়ে, গানের চেয়ে ও আমাকে আলাদা করে কখনো ভালোবাসতে পারে নি, বেশ কিছুদিন পরে আমি একথা বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি বলবে তাহলে অন্য সবকিছুই যখন ছেড়ে দিলো। মানুষটা, সেখানে তুমি টিকে গেলে কি করে! আমি তো আর ছিটের খোলে মোড়া কঙ্কালের মতো একটা এস্রাজ কিংবা ম্যাজিক দেখানো জারিজুরি করা তাসের প্যাকেট নই, যে ছেড়ে দিলেই অমনি ল্যাঠা চুকে যাবে। ও ছাড়লেও আমি তো আর ওকে ছাড়ছিনে; এস্রাজ কিংবা তাসের প্যাকেটের সঙ্গে আমার তফাতটা শুধু এইখানেই। এখন যে ও সেই আগের মতো গল্প জমাতে পারে না, গান গাইতে পারে না, তার জন্যে ওর কিন্তু কোনো খেদ নেই। দেখলাম এই নিয়ে যা কিছু মাথাব্যথা সব একা আমার। রাজ্যির সব গ্রহরত্নের মধ্যে ডুবে আছে। ওই গ্রহরত্ব গ্রহরত্ন করে ছেড়ে দিলো চাকরিটাও। তুমি শুনতে চাও আর না চাও পাথরের গল্প শোনাতে শোনাতে রাত ভোর করে দিতে পারে ও এখন।
একেবারে ওই জগতে তলিয়ে গেছে বলতে পারো। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় রেখে এক একটা পাথরের দিকে তাকিয়ে প্রায় সারারাত কাবার করে ফ্যালে এখন। বলে মানুষের তৈরি জিনিস নিয়ে অনেকেই তো নাড়াচাড়া করে, এ হচ্ছে প্রকৃতির জিনিস, স্বয়ং খোদার হাতে তৈরি, এর চেয়ে মহার্ঘ আর কি হতে পারে। আসলে এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করার নেশা করে দিনরাত রুজির ধান্ধায় বুদ হয়ে আছে। চাকরিতে কটা টাকারই-বা সংস্থান হয় বরং এটা একটা স্বাধীন ব্যবসা; বাইরে থেকে ওর এই পেশাটাকে তাই ভীষণ একটা লাভজনক ব্যাপার বলে মন হয়। কিন্তু আমি জানি, লাভের কথা ভেবে, অঢেল কামাই করার লোভে ও এ পথে পা বাড়ায় নি। টাকা-পয়সার জন্যে মাতলামি ওর স্বভাবে কখনো দেখি নি, বরং উল্টোটাই সবসময় মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে একটু বেশি রকমেরই উদাসীন। অষ্টপ্রহর এই যে, গ্রহরত্ব গ্রহরত্ন করে কুঁদ হয়ে আছে, মানুষটা সেটা আর কিছু নয়, মদের মতো একটা নেশা। যা একদিন ওর স্বভাবে ছিলো গান গাওয়া, এস্রাজ বাজানো, সেই নেশারই অন্য চেহারা, যেমন একদিন ভালোবাসতো আমাকেও। উৎস একটাই। মন উঠে গেছে বলে নিছক আত্মপক্ষ সমর্থন করার ফন্দি এঁটে পেটবানান্তি কথার রাশ মেলে। ধরছি, তুমি নিশ্চয়ই এই ধরনের একটা কিছু ভাবছো। বিশ্বাস করো, এসব কথার পিঠে স্রেফ কথা নয়, হঠাৎ কোনো মন কচলানির জেরও নয়। যা কষ্ট দেয়, যা খিচড়ে দেয় আমার মনকে, নষ্ট করে মনের শান্তি, তার মুখোমুখি দাঁড়াতে আমি ভালোবাসি: চিরকেলে স্বভাব ওটা আমার। আগেই তো বলেছি, জীবনের জটিলতাকে আমি ঘৃণা করি, মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। দরকার হলে জট ছাড়িয়ে নিই, না পারলে চেষ্টা করি পাশ কাটিয়ে যাবার। পুরানো কথায় ফেরা যাক। নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেই ধরে নিতে পারো, শেষ পর্যন্ত স্বামীর সবকিছুর এইভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে হলো। যেটা আমার স্বভাব জিগ্যেস। করলাম নিজেকে, স্পষ্ট জবাব চাইলাম নিজের কাছে। উত্তরও পেলাম। গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এস্রাজ থেকে আমি, শেষে গ্রহরত্ব; আমি ভেবে দেখলাম ও ঠিকই আছে, ওর পিছনের দিকে তাকাবার অবসরই নেই। ওর প্রাণশক্তি আছে, একটা ছেড়ে আরেকটায় যাবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমার? সবকিছু একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার মনে হলো আমার। ভিতরের সব কষ্ট, সব খোদ, গ্লানি, যা এতোদিন ঘোঁট পাকাচ্ছিলো কেবল স্বামীকে ঘিরে সহসা তা ঝলমল করে ঝলসে উঠলো; এইবার নিজেকে নিয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন পর নিজের জন্যে স্বার্থপরের মতো ব্যাকুল হয়ে পড়লাম, নিরাকার ভূতুড়ে আয়নার সামনে মেলে ধরলাম নিজেকে। রীতিমতো উল্টো ব্যাপার। এতোদিন স্বামীর কথা ভেবে যতো খেদ স্তূপাকার করেছি, তা কেবল নিজের জন্যে, নতুন করে জীবনের দিকে তাকাবার জন্যে! কি অবস্থায় এসে ঠেকেছি, আমি ভাবলাম, এ আমি কোথায়, দুর্দশার ভিতরে একেবারে গলা পর্যন্ত জুবড়ে পড়ে আছি; এমন কি অবশিষ্ট আছে আমার? উচ্ছিষ্ট! কারো পাতে দেয়ার মতো নয়, উল্টেপাল্টে দেখলাম যতো রকমে পারা যায়। পাগলের মতো অবস্থা আমার। হেঁশেলের কোণে পড়ে থাকা শিলনোড়া, কিংবা উঠোনের একপাশে ফেলে রাখা মুড়োঝাঁটা, আমি তো এই-ই! নচেৎ একটা পুরানো আমলের সুখপাঠ্য বই, যা খুব যত্ন করে আর কোনোদিন পড়া হবে না এমন এক ভঙ্গিতে ঠেসে দেওয়া হয়েছে দেয়ালের নোনাধরা তাকে; বৃষ্টিতে ভিজে পচার কিংবা অক্ষরগুলো ধুয়েমুছে যাবার কোনো ভয় নেই ঠিকই, কিন্তু ভাঁজে ভাঁজে আস্তানা গাড়বে কীট, দিনের পর দিন কুরে কুরে খেয়ে খাস্তা ঝরঝরে করে দেবে। এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঢের ভালো; গরল ঘুলিয়ে উঠলো আমার ভিতরে। হাঁসফাঁস করতে লাগলাম, এমন একটা সাইক্লোন কি টর্নেডো আসে না কেন যা বাড়িটাকে গুঁড়িয়ে দেবে, তাক থেকে উড়িয়ে দেবে বইটিকে, প্রতিটি অনুচ্ছেদ খসিয়ে নিয়ে ছিড়ে কুটি কুটি করে উড়িয়ে দেবে রাজ্যময়, হাততালি দিয়ে হো হো করে হাসবে। তুমি এলে ঠিক এই সময়–