নিবারণ ওঝা হাঁটছে রাজকীয় চালে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। কথাবার্তা তেমন বলছে না। মাঝে হঠাৎ দাঁড়িয়ে সন্দেহজনকভাবে চারদিকে তাকাচ্ছে। সবাই থমকে দাঁড়াচ্ছে। তাদের কৌতূহল যখন তুঙ্গে, তখনই আবার সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করছে।
জীবন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। নিবারণ ওঝা হয়তো এ-মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলবে, হয়তো তুলবে না। এই সময়টির মতো রহস্যময় সময় আর কী কতে পারে?
মনিরউদ্দিনকে উঠোনের মাঝখানে একটি জলচৌকিতে বসানো হয়েছে। হয়তো সূর্যের আঁচেই তার মুখ লাল হয়ে আছে। চোখের কোণ ফোলা-ফোলা।
নিবারণ নতুন গামছা পানিতে ভিজিয়ে মনিরউদ্দিনের মুখ মুছিয়ে গামছাটা তার কাঁধে জড়িয়ে দিল। শান্ত গলায় বলল, হাত-মুখ ধোয়ার জল দেন আমারে। কালা গাইয়ের দুধ জোগাড় হইছে?
জানা গেল দুধের জোগাড় এখনো হয় নি।
কাঁইক্যা মাছের দাঁত দরকার। চাইর-পাঁচটা নতুন কলাপাতা আনেন। পিতলের কলসিতে এক কলসি জল দেন। আর শুনেন মা সকল, আপনারার মধ্যে যারা বিধবা, তারা মন্ত্র পড়ার সময় দূরে থাকবেন। অপরাধ নিয়েন নাগগা মা সকল। এইটাই হইতাছে নিয়ম।…
পুলাপানরে দূরে থাকতে কন। এইটা রঙ্গ-তামাশার জায়গা না। বড় কঠিন। সমস্য।
কালো গাইয়ের দুধ এসে পড়েছে। নিবারণ মনিরউদ্দিনের সাপে-কাটা পায়ের গোড়ালি দুধে ড়ুবিয়ে মুখ অন্ধকার করে ফেলল।
বিষ খুব তেজী। উঠছে অনেক দুর। কালনাগের বিষ। বড় কঠিন সমস্যা।
মন্ত্রপাঠ শুরু হল। ছোটখাটো নিবারণ ওঝা, এখন একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব। তার কণ্ঠ গমগম করছে–
ও বালা লখিন্দররে…
কোন কাল ভুজঙ্গ তরে খাইলরে!……
এতগুলি মানুষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবারণ ওঝার মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এক সময় নিবারণ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। ঠিক তখন শরিফার কান্নার শব্দ শোনা গেল। সে কাঁদছে ক্ষীণ স্বরে। কিন্তু মাঝে। মাঝে ক্ষীণ স্বরও তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
মনিরউদ্দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, তিয়াষ লাগছে, পানি দে। ও শরিফা, শরিফা।
তার চারপাশে এতগুলি মানুষ, কিন্তু সে নির্লজ্জর মতো স্ত্রীকে ডাকছে।
নিবারণ বলল, পানি অখন খাইয়েন নাগগা বাপধন। তালমিছরির টুকরা চোষেন। পানি খাইলে শরীর টিলা হইয়া যাইব।
হউক টিলা ও শরিফা, পানি দে।
নিয়ম-কানুন তো আছেগগা বাপধন।
থাউক নিয়ম-কানুন ও শরিফা, শরিফা।
নিবারণ হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল সবার দিকে, তারপর এমনভাবে মাথা নাড়ল, যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সে কোনো আশা দেখছে না।
জলিল কড়া ধমক দিল, মনির, ওঝা যা কইতেছে হোন।
পানির তিয়াষ লাগছে।
তিয়াষ লাগছে পানি খাইবা। এট্টু সবুর কর।
অনেকেই কথা বলে উঠল। সবারই একই বক্তব্য, সবুর কর। নিবারণ বাঁ হাতে এক চিমটি স্বর্ণসিন্দুর নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতোর সঙ্গে মন্ত্রপাঠ শুরু করল–
ভৈরবী ছিন্নমস্তা, চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।
বগলা সিন্ধাবিদ্যা চ মাতাঙ্গি কমলাত্রিকা।
এতো দশমহাবিদ্যাঃ সিন্ধাবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিকা।……
নিবারণের মুখে ফেনা জমে উঠছে। রক্তবর্ণের চোখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা। তাকে এই জগতের মানুষ বলে এখন আর মনে হচ্ছে না। অনেকখানি দূর থেকে ডান হাত ঘোরাতে ঘোরাতে সে ছুটে আসছে। থমকে দাঁড়াচ্ছে মনিরউদ্দিনের সামনে। ঝড়ের বেগে নেমে আসছে ঘুরন্ত হাত। সেই হাত গিয়ে পড়ছে মনিরউদ্দিনের উরুতে। মনিরউদ্দিন প্রতিবারই ধমকে উঠছে—আহু, কী করেন?
নিবারণ অতি দ্রুত কী-সব বলছে তা এখন আর বোঝার উপায় নেই। শব্দ হচ্ছে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো। কতক্ষণ এরকম চলবে কে জানে?
ময়মনসিংহ থেকে উত্তরের দিকে
ময়মনসিংহ থেকে উত্তরের দিকে যে-ব্রাঞ্চ লাইনটি গিয়েছে, তার শেষ স্টেশনটির নাম মোহনগঞ্জ। স্থানীয় লোকজন একে উজান দেশ বলেই জানে, যদিও নাবাল অঞ্চলের শুরু এখান থেকেই। শুকনো মরশুমে কিছু বোঝার উপায় নেই। দিগন্তবিস্তৃত বৃক্ষহীন বিশাল মাঠ। এঁকেবেঁকে তার ভেতর দিকে চলে গেছে পায়ে-চলা পথ। সেই পথ ধরে উত্তরে যাওয়া মানেই ভাটি অঞ্চলে গিয়ে পড়া। চট করে কিছু বোঝার উপায় নেইউজান দেশেও এরকম বিশাল মাঠ আছে, কিন্তু ভাটির মাঠগুলি কেমন যেন অন্যরকম। এই মাঠের হাওয়ায় কিছু-একটা যেন আছে। এ-অঞ্চলের সঙ্গে পরিচয় নেই এমন মানুষজন এক ধরনের চাঞ্চল্য অনুভব করেন। তাঁদের কাছে মনে হয় এমাঠ শুধু মাঠ নয়, এর অন্য কোন পরিচয় আছে।
সে-পরিচয় বোঝা যায় বর্ষায়। কী বিপুল পরিবর্তন। মাঠ কোথায়, এ তো বিশাল সমুদ্র। জল থৈথৈ করছে চারদিকে। প্রকাণ্ড সব ঢেউ উঠছে, গুমগুম শব্দ আসছে কোনো গোপন জায়গা থেকে। এ কেমন দেশ।
অচেনা মানুষের কাছে মনে হতে পারে এ বোধহয় বিরান জলাভূমি। সহজে কিছু চোখে পড়বে না। বিশাল জলরাশির মধ্যেই খানিকটা উঁচু জায়গা। অল্প কিছু ঘর নিয়ে ছোট্ট জনপদ। হাওড়ে দিক-হারিয়ে-ফেলা কোনো নৌকার মাঝি চিৎকার করলে এরা সাড়া দেবে। রাতের বেলা লণ্ঠন ঝুলিয়ে আলো দেখাবে।
এরা ছ মাস থাকবে জলবন্দি অবস্থায়। সেটাই সম্ভবত তাদের সুখের সময়। কাজকর্ম নেইগান-বাজনা, বাঘবন্দি খেলা, আর লম্বা ঘুম। এ-সময়ে এখানকার মানুষদের শরীরে নেমে আসে অদ্ভুত এক আলস্য। মেজাজ হয়ে যায় রাজা-বাদশাদের মতো।
বিয়ে-শাদির উৎসবে জমানোটাকাপয়সা সব খরচ করে ফেলে। তারপর এক সময় জল নেমে যায়। জেগে ওঠে থকথকে কাদার মাঠ। পলিভতি সোনা-ফলানো জমি। ভাটি অঞ্চলের মানুষরা গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে। শুরু হয় অমানুষিক পরিশ্রম। জমি তৈরি হয়, ফসল বোনা হয়। ফসল কেটে ঘরে তুলে তারা আবার জলবন্দি হয়ে যায়। বড় সুখের সময় সেটা।