নিবারণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি ওঝা। সাপের বিষ ঝাড়ি।
কড়ি চালনা জানেন?
তা জানি। জানুম না ক্যান? বিদ্যা শিখছি।
কোনোদিন কড়ি চালনা করে সাপ এনেছেন?
জ্বে আজ্ঞে, আনছি।
মিথ্যা কথা বলতে মুখে আটকায় না? সত্যি কথা বলেন, নয়তো অষুধ দেব না।
ডাক্তার কেমন নিষ্ঠুরের মতো তাকিয়ে থাকেন। বিড়বিড় করে বলেন, এইসব ঝাড়ফুকের ওস্তাদরা গরিব মানুষগুলিকে লুটেপুটে খাচ্ছে।
কী অদ্ভুত কথা! লুটেপুটে খেলে নিবারণের আজ এই অবস্থা? নিবারণের জ্যাঠার ছেলে কৃষ্ণ যদি খাবার নিয়ে আসে, তাহলেই তার খাওয়া হয়। কৃষ্ণ একবারই খাবার আনে-দুপুরে। সকাল থেকে নিবারণ ভাবে, আজ কী খাবার আনবে কৃষ্ণ? প্রায়ই মিলে যায়। তখন বড় আনন্দ হয়।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে কৃষ্ণ ভালো কিছু আনবে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই মনে হচ্ছে। খিদেও এই কারণে খুব জানান দিচ্ছে।
ঘরে কিছু মুড়ি আছে। মুড়ি খেয়ে কয়েক ঢোক পানি খেলে হয়। কিন্তু নিবারণের উঠতে ইচ্ছা করছে না। খিদে নষ্ট করে লাভ নেই। কৃষ্ণ যদি সত্যি-সত্যি ভালো কিছু আনে!
তার খড়ের ছাউনির একচালাটির তার মতোই অন্তিম দশা। গোলঞ্চ আর বয়রা গাছের জঙ্গল চালটিকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। এই অঞ্চলের এত নামী একজন ওঝার বাসস্থানটি দেখে চমকে যেতে হয়।
জলিল মিয়াও চমকে গেল। বাড়ির উঠোনে নিবারণ ওঝা বসে আছে। লাল চোখে তাকিয়ে আছে একসারি পিপড়ার দিকে। কিছুক্ষণ পরপরই প্রবল বেগে মাথা চুলকাচ্ছে। মাথায় চুল নেই বললেই হয়। অল্প যা আছে, তাতে জটা ধরেছে। জলিল বলল, নিবারণ ভাই ভালো আছেন?
নিবারণ মাথা চুলকানো বন্ধ করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোন গ্রাম?
বানিয়াবাড়ি।
নৌকা আনছেন?
আনছি।
রুগী পুরুষ না মাইয়া?
পুরুষ।
আইছা। বসেন, জামাটা গায়ে দিয়া আসি।
বসার কোন জায়গা নেই। জলিল দাঁড়িয়ে রইল। নিবারণ ওঝার সঙ্গে আর কেউ বোধহয় থাকে না। বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। জলিল মিয়াকে দীর্ঘ সময় একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে হল। জামা গায়ে দিতে নিবারণ ওঝার এত সময় লাগার কথা নয়।
একটু দেরি হইল। মুড়ি ছিল চাইরডা, খাইলাম। খিদা লাগছিল।
জলিল মিয়া লক্ষ করল, নিবারণ বেশ ফর্সা একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে এসেছে। পায়ে রবারের জুতা।
আপনেরে পান-তামুক কিছু দিতে পারলাম না। ঘরে কিছু নাই।
কিছু দরকার নাই নিবারণ ভাই। আপনেরে পাওয়া গেছে, এইটাই বড় কথা।
আপনের নাম কি?
জলিল।
রুগী আপনের কে হয়?
আমার কিছু হয় না। দোস্ত মানুষ।
কাটছে কোন সময়?
ভোররাইতে।
আপনেরে একটা কথা কই। রুগী বাঁচানি মুশকিল হইব। মঙ্গলবারে কাটছে। শনি আর মঙ্গল এই দুই দিনে সাপের বিষের তেজ থাকে বেশি। বুঝলেন বিষয়ডা?
জলিল জবাব দিল না। সে লম্বা-লম্বা পা ফেলছে। নিবারণকে যত তাড়াতাড়ি গ্রামে নিয়ে উপস্থিত করা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু নিবারণ হাঁটতে পারছে না। একটা পা টেনে-টেনে সে যাচ্ছে। এই লোকটিরও সময় বোধহয় শেষ হয়ে আসছে। থামতেও হচ্ছে নানান জায়গায়। গ্রামের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। হাজারো প্রশ্ন করছে।
কোন গ্রামে?
কারে কাটল?
ক্যামনে কাটল?
বয়স কত?
কী সাপ?
জলিল এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো আগ্রহ বোধ করছে না, কিন্তু নিবারণ করছে। সে শুধু যে দীর্ঘ সময় নিয়ে উত্তর দিচ্ছে তাই নয়, উত্তরের শেষে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে শনি-মঙ্গলবারে কৃষ্ণপক্ষের সময় সাপে-কাটা রুগী বাঁচান অসম্ভব ব্যাপার। অন্য কোন ওঝা হলে ঘর থেকেই বেরুত না, সে বলেই বেরুচ্ছে।
নৌকায় উঠেও নিবারণের কথা বন্ধ হল না। নিজের মনেই বকবক করতে লাগল। তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, ওঝাগিরি করে তার লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে স্বাস্থ্য নষ্ট, মনের শান্তি নষ্ট। বাড়িতে দালান-কোঠা ওঠে নি। সিন্দুক টাকাপয়সায় ভর্তি হয় নি। কারণ রুগীর কাছ থেকে টাকাপয়সা নেওয়া ওস্তাদের নিষেধ। অবশ্যি রুগী ভালো হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে যদি পালাপার্বণে খুশি হয়ে কেউ কিছু দেয় তাতে দোষ হয় না। কিন্তু কেউ দেয় না।
সব ঠনঠন। বুঝলা, ঠনঠন। দুই বেলা পেটে ভাত হয় না।
শিখলেন ক্যান এই কাম?
জানি না ক্যান শিখলাম, অখন পস্তাই। রাইতে ঘুম হয় না। বিছানার কাছে সাপ আনাগোনা করে। এরা সুযোগে আছে। বুঝলা, সুযোগ খুঁজছে। আমার দিনও শেষ।
বয়স কত আপনের?
কে জানে কত! হিসাবপত্তর নাই।
বিয়া-শাদি করেন নাই?
করছিলাম। বৌটা মরছে সাপের কামড়ে। ঘরে ছিলাম না। এই সুযোগে কাম শেষ করছে।
নিবারণ একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
সারা রাইত বাত্তি জ্বালাইয়া রাখতে হয়। সাপের আনাগোনা জ্বালাইতে কেরোসিন লাগে, কে দিব কেরোসিনের পয়সা।
জলিল দ্রুত বৈঠা ফেলছে। বাতাস দিচ্ছে। বাতাস কেটে যেতে হচ্ছে বলেই বড় পরিশ্রম হচ্ছে। বুদ্ধি করে আরেকজন কাউকে সঙ্গে করে আনলে হত। নিবারণ চোখ বন্ধ করে আছে। সম্ভবত ঘুমিয়েই পড়েছে।
জলিল লক্ষ করল রোদের তেজ একটু যেন কম। তার বুকে ছাৎ করে উঠল। ঢল নামবে না তো? সর্বনাশ হয়ে যাবে। ধান কটা মাত্র শুরু হয়েছে। অবশ্যি আকাশ চকচকে নীল। এক খণ্ড মেঘও নেই। তবু জলিলের মনে হল, রোদের তেজে ভাটা পড়েছে। নিশ্চয়ই মনের ভুল।
বানিয়াবাড়ির মাটিতে নেমেই নিবারণ গম্ভীর মুখে ঘোষণা করলনয়া মাটির পাতিলে এক পাতিল কালা গাইয়ের দুধ লাগব। একটা পাঁচহাতি গামছা, স্বর্ণসিন্দুর আর তালমিছরি লাগব।
গ্রামে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। ওঝা বিষ ছাড়াতে এসেছে, এমন উত্তেজনার ব্যাপার দীর্ঘদিন এই গ্রামে ঘটে নি। গ্রামের সব মানুষ ভেঙে পড়ল মনিরউদ্দিনের বাড়িতে।