বড়-বড় অভাবের সময় এরকম দু-একটা মেয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এটা নতুন কিছু না, আগেও গিয়েছে। এদের যাওয়াই উচিত। তবু শেষ সময়ে নিয়ামত খাঁ আপোসের স্বর বের করছেন শুনে সবাই অবাক হয়। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এর মানে কী? নিয়ামত খাঁ তাদের অস্বস্তি টের পান। মুখ থেকে দয়া ভাব মুছে ফেলে কঠিন স্বরে বলেন, তবে একটা কথা চাঁনসোনা, এম্নে থাকন সম্ভব না, তোমারে নিকা করন লাগব। আমার কথা বুঝছ?
মাতব্বররা এবার নড়েচড়ে বসেন। আলোচনার এই অংশটা তাদের ভালো লাগে। চাঁনসোনার শরীরে অভাব-অনটনের ছাপ নেই। গোলাকার মুখে স্নিগ্ধ ছায়া। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-গৌর। চুলের গোছা নদীর ঢেউয়ের মতো ঢেউ তুলে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।
বিয়া-শাদি কইরা থাকবা ভদ্রলোকেরা মাইয়ার মতো। কাজ-কাম করব।
কে আমারে বিয়া করব?
নিয়ামত খাঁর গা জ্বলে গেল। কত বড় সাহস, নিজের মুখে বিয়ের কথা বলছে, একটুও আটকাচ্ছে না। গলার স্বরেও কোনো রকম অস্পষ্টতা নেই। তিনি নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন, শখ কইরা কেউ তোমারে বিয়া করত না। দয়া কইরা করব।
কে করব এই দয়া? আফনে?
চুপ হারামজাদি, যত বড় মুখ না তত বড় কথা! শইল্যে তেল বেশি হইছে? তর একটা উবগার করতে চাই, তুই বুঝস না?
তুই-তোকারি কইরেন না।
নিয়ামত খাঁ স্তম্ভিত হন। অন্য মুরুব্বিরা উদাস চোখে তাকান। ঘন-ঘন মাথা নাড়েন। কী অবস্থা! মেয়েমানুষ, কিন্তু কী তেজ। এমন তেজ ভালো না। এমন তেজের কপালে লাথি।
চাঁদসোনা খুনখুন করে কাঁদে। সেই সঙ্গে ঘন-ঘন চোখ মোছে। কাঁচের চুড়ি বেজে ওঠে তখন। বিধবা মেয়েমানুষ, কিন্তু হাতে চুড়ি। পরনে ছাপের শাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর পর সাত বিধবা গিয়েছিল চাঁনসোনার কাছে। গোসল দেবে। গোসলের পর রঙিন শাড়ি বদলে সাদা শাড়ি পরিয়ে দেবে। চাঁনসোনা রাজি হয় নি। সে সাদা শাড়ি পরবে না। এই মেয়ে যে শেষমেষ এক কাণ্ড করবে, সেটা তো জানা কথা। এখন আবার কাঁদতে শুরু করেছে। মাররা বড় বিরক্ত হন। মোত্তালেব মিয়া উদার গলায় বলে, কাইলো না। খামাখা কান্দ ক্যান? তোমারে মারছি না ধরছি?
চাঁনসোনা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলে, আমি এই গেরামে থাকুম না।
যাইবা কই?
হেইটা দিয়া আপনে কী করবেন? যাইতে কইছেন, যাইতেছি।
আরে, এইটা তো বদ মেয়েমানুষ।
চাঁনসোনা গ্রাম থেকে জন্মের মতো যাবে, এটাই সাব্যস্ত হল। তার আগে চাঁনসোনার মাথা মুড়িয়ে দেবার প্রস্তাব উঠেছিল। নিয়ামত রাজি হন নি। মুখে বিরক্তির ভঙ্গি করে বলেছেন, শইল দেখাইয়া খাইব। চুল কাটলে হে দেখাইব কী? বাদ দেও।
পুরোপুরি বাদ অবশ্যি দেওয়া হয় না। দশ ঘা জুতার বাড়ি দেওয়া হয়। সেই দৃশ্য দেখার জন্যে সমস্ত গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে। অভাব-অনটনের মধ্যে দীর্ঘদিন পর প্রবল উত্তেজনার একটা ব্যাপার ঘটে। দশ ঘা জুতার বাড়ি খেয়েও মেয়েটার চোখে পানি আসে না কেন, এই নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়।
মনিরউদ্দিন তার মামির বিদায়ের ব্যাপারটি সহজভাবেই নিল। কান্নাকাটি করল না, সঙ্গে যাবার বায়না ধরল না—একবার শুধু বলল, আর আসবা না?
আসমু, আবার আসমু। এই গেরামে আমার কবর হইব। বুঝছস?
মনিরউদ্দিন কিছুই বুঝল না। কিন্তু মাথা নাড়ল, যেন সে বুঝেছে।
একটা কথা মন দিয়া হু মনির মিয়া-মাইয়ামাইনষের উপরে কোনোদিন বেজার হইস না। এরা না পাইরা অনেক কিছু করে, না বুইজ্যা করে।
তুমি আবার আসবা?
একবার তো কইলাম। কয়বার কওন লাগব রে বোকা বান্দর?
মনিরউদ্দিন দেখল, মামি যাবার আগে সাজগোজ করছে। একটা ভালো শাড়ি পরেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। সুন্দর লাগছে মামিকে।
তুই কোনো চিন্তা করি না। তুই এই গেরামের পুলা। তরে এরা দেখাশুনা করব। মানুষ পাষাণ হয় নাই। মায়া-মুহত মানুষের মধ্যে আছে।
তুমি কই যাইছ?
জানি না। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার বাপ মরল, মা বিয়া করল মই ধ্যম নগরের এক বেপারিরে। তারপর আর মার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নাই। এখন পরথম যাইবাম মইধ্যম নগর। তারপরে দেখি। অনেক দূরের পথ। উজানের দেশ।
চাঁনসোনা মনিরউদ্দিনকে নিয়ামত খাঁর বাংলাঘরে বসিয়ে বেশ সহজ ভঙ্গিতে কেরাইয়া নৌকায় উঠল। ভাদ্র মাসের কানায়-কানায় ভরা নদী—একূল থেকে ওকূল দেখা যায় না। চাঁনসোনা টিনের ট্রাংকের উপর বসে আছে মূর্তির মতো। নৌকার মাঝি বলল, ওগো ভালোমাইনষের মাইয়া, ছইয়ের ভিতরে গিয়া বসেন।
চানসোনা জবাব দিল না। যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল। কতকাল আগে এক শ্রাবণ মাসে তের বছরের চাঁনসোনা এই গ্রামে এসেছিল। লম্বা ঘোমটার ফাঁকে অবাক হয়ে দেখেছিল ভাটি অঞ্চল। অচেনা এই জায়গাটির জন্যে কেমন এক ধরনের মমতা জন্মেছিল। আজ সেই মমতা বহুগুণে বেড়ে তাকে ভাসিয়ে নিতে চাইছে। এতটুকু মাত্র শরীর মানুষের, এত মমতা সে কোথায় ধারণ করে?
নৌকার মাঝি বলল, কাইন্দেন না মা। মনটারে পাষাণ করেন। ছইয়ের ভিতরে গিয়া বসেন। পানি দেখলেই চউক্ষে বেশি পানি আসে। পানি খুব নরম জিনিস গো ভালোমাইনষের ঝি, খুব নরম জিনিস।
নিবারণ ওঝার বয়স
নিবারণ ওঝার বয়স সত্তরের উপরে।
দড়ি-পাকানো চেহারা। মুখটি অসম্ভব ক্ষুদ্র। বছর দশেক আগে বা চোখে মানকাঁটার খোঁচা লেগেছিল। সেই চোখটি নষ্ট। অন্য চোখটি অস্বাভাবিক লাল। লাল চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। রাতে সব কিছুই ছায়া-ছায়া মনে হয়। দিনে রোদের আলোয় চোখ মেলতে পারে না। করকর করে। সারাক্ষণই চোখ থেকে আঠাল কষের মত পানি ঝরে। বড় কষ্ট হয়। সার্বক্ষণিক কষ্টও এক সময় সহ্য হয়ে যায়। নিবারণ চোখের যন্ত্রণা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারে। গত বছর গঞ্জের হাসপাতালে গিয়েছিল। ডাক্তার চোখে টর্চের আলো ফেলে বিরক্ত মুখে বললেন, আপনি কী করেন? চাষবাষ না অন্য কিছু?