দুনিয়ার সব জায়গা তো এক রকম না।
তা ঠিক, তা ঠিক। আল্লাহপাক বালির দেশও বানাইছে। যেমন ধরেন মরুভূমি।
বজলু সরকার উত্তর দেন না। রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। মৌলানা সাহেব নিজের মনেই কথা বলেন, আল্লাপাকের খাস রহমতের জায়গা হইল গিয়া মরুভূমি। নূরনবীর জন্মস্থান।
এখন বাড়িত যান মৌলানা সাব।
জ্বি আচ্ছা। আমি একটা কথা কইতে আসছিলাম।
কি কথা?
ভাবছি দেশে চইলা গেলে কেমন হয়?
যাইতে চাইলে যান। আপনেরে কেউ বাইন্ধা রাখছে?
মসজিদে নামাজ হবে না এইটা নিয়ে মনে একটু কষ্ট, নামাজঘরে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হওয়া লাগে, না হইলে আল্লাহ্পাক খুবই নাখোশ হন। আল্লাহ্র গজব নামে।
গজবের আর বাকি আছে?
তাও ঠিক। খুবই ন্যায্য কথা।
বাড়িত যান-বাড়িত গিয়া ঘুমান।
খবির হোসেন চিন্তিত মুখে বাড়ি ফেরেন। রাতে তাঁর ঘুম হয় না। কী সর্বনাশের দেশ। এমন দেশে মানুষ থাকে? নাকি এটা তাঁর ভাগ্য? যেখানে যান সেখানকার অবস্থাই বদলে যায়। তিনি কি মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা সাথে করে নিয়ে আসেন। এরকম অপয়া লোক কিছু-কিছু আছে। দুর্ভাগ্য তাদের ঘিরে থাকে। শুধু তাদেরই না, যারাই এইসব লোকজনের সংস্পর্শে আসে তাদেরও এই অবস্থা। তিনি নিজের জীবনেই এটা লক্ষ করেছেন। কত জায়গায় গেলেন, সুখে-শান্তিতে জীবন শুরু করলেন। যেই ভাবলেন এইবার স্থায়ী হবেন, যাযাবর জীবনের ইতি করবেন, নিজের ঘরসংসার, সামান্য কিছু জমিজমা, ধবধবে সাদা রঙের একটা গাই, উঠোনে পুঁইয়ের মাচা, বাড়ির পেছনে লকলকে ডাঁটা খেত, কয়েকটা হাঁস-মুরগি, সন্ধ্যাবেলায় যাদের ঘরে আবার জন্যে তাঁর স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে বেরুবে, নিচু গলায় বলবে, তই তই তই ঠিক তখন একটা ঝামেলায় সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হয়েছে। আল্লাহপাক এত নারাজ কেন তাঁর উপর? তিনি কি আল্লাহপাকের আদেশ মাথা পেতে পালন করেন নি? রসুলে করিমের শিক্ষা অন্যদের বলেন নি? ভুলত্রুটি তিনি যদি কিছু করেই থাকেন, না-বুঝে করেছেন। আল্লাপাক তার জন্যে এমন কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কেন করবেন? তিনি হচ্ছেন রহমতের সাগর। সেই রহমতের ছিটেফোঁটাও কি তাঁর জীবনে আসবে না? তিনি কি এতই নাদান। রাত জেগে খবির হোসেন তাহাজ্জতের নামাজ পড়েন। বিড়বিড় করে বলেন দয়া কর, দয়া কর। পানা দাও। আমার জন্যে গ্রামের মানুষগুলিকে তুমি কষ্ট দিচ্ছ কেন? এদের মুক্তি দাও।
খবির হোসেনের বারবার মনে হয়, তিনি গ্রাম ছেড়ে গেলেই সবসমস্যার সমাধান হবে। এই বানিয়াবাড়িতে সুখের প্লাবন বইবে। এমন ফসল ফলবে যে কেটে আনতে ইচ্ছা করবে না। চাঁদের ফকফকা আলোয় ছেলেপুলেরা ছোটাছুটি করবে। বৃদ্ধবৃদ্ধারা ভরপেটে ঘুমুতে যাবে।
অভাব চরমে ওঠে ভাদ্র মাসে। হাড়-জিরজিরে শিশুরা অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়। বেশির ভাগ সময়ই তারা ঘাটে বসে থাকে। কিছুদিন আগে বড় নৌকায় করে সাহায্য এসেছিল। আটা, চিড়া এবং অষুধপত্র। তারা বলে গিয়েছিল আবার আসবে। যদি আসে। সাহায্যের লোকজন আসে না, কিন্তু নানান ধরনের মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। এই ধরনের লোকদের অভাবের সময় দেখতে পাওয়া যায়। এদের কথাবার্তা খুব মোলায়েম। গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। মিনিটে-মিনিটে সিগারেট সাধে। বানিয়াবাড়ির সবাই জানে, এরা হচ্ছে মতলবাজ লোক। বদ মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তবু চুপ করে থাকতে হয়। দুঃসময়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।
গ্রামের মাত্ররা যদিও বলে বেড়ায়—কেউ যেন হালের গরু বিক্রি না-করে। গরু চলে গেলে হাল বন্ধ হয়ে যাবে। সব বেচে দিক, কিন্তু গরু যেন থাকে। অনেকেই তাদের কথা শোনে না। নানান কিসিমের নৌকায় ভাটি অঞ্চলের গরু-ছাগল পার হতে থাকে। পশুরা গভীর মমতায় চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে থাকে গ্রামের দিকে। ভাদ্র মাসের ভরা নদী ছল-ছলাৎ করে।
এই রকম চরম দুঃসময়ে মনিরউদ্দিনের মামি চাঁনসোনার ঘরে গ্রামের মাত্ররা একত্র হন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ হচ্ছেন নিয়ামত খাঁ। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, এইসব কি করতাম তুমি চাঁনসোনা? ছিঃ ছিঃ।
চাঁনসোনা উত্তর দেয় না। দরজার ওপাশ থেকে তার কাঁচের চুড়ির শব্দ পাওয়া যায়।
অভাব তো আছেই। বেজায় অভাব। শুধু এই গ্রাম তো না, ভাটি অঞ্চলে কোনো খাওন নাই। তাই বইলা রাইতে-বিরাইতে বিদেশি লোকজন তোমার ঘরে আনাগোনা করব?
চাঁনসোনা ফিসফিস করে কী উত্তর দেয়, পরিষ্কার শোনা যায় না। নিয়ামত খা গলা খাকারি দিয়ে বলেন, তুমি এই গেরাম ছাইড়া যাও গিয়া।
কই যামু,কন?
বাপের বাড়ির দেশে যাও। ভাই-বেরাদরের সাথে গিয়া থাক।
বাপের বাড়িত আমার কেউ নাই।
তুমি মানুষের চউখের উপরে আকাম-কুকাম করতাছ। এর আগেও দুইবার খবর দিছি। দেই নাই? তোমার গেরাম ছাড়ন লাগব চাঁনসোনা।
মনির মিয়ারে কী করমু? হে কী খাইব?
তার ব্যবস্থা হইব। রুজিরোজগারের মালিক আল্লাহুপাক। তুমি-আমি কেউ না।
দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। নিয়ামত খাঁ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি থাক, কিন্তু খবরদার, আর যেন কিছু না শুনি।
নিয়ামত খাঁর গলায় মমতা টের পাওয়া যায়। মমতার কারণ স্পষ্ট নয়। আলোচনা শুরুর আগে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন এইজাতীয় মেয়েছেলে গ্রামে রাখা যাবেনা। জোয়ান ছেলেপুলের চরিত্র নষ্ট করবে। এরা থাকুক যেখানে তাদের মানায়, সেখানে। গঞ্জের খুপরিতে। সন্ধ্যায় পান খেয়ে ঠোঁট লাল করবে। ঘরের দাওয়ায় অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। ইশারা-ইঙ্গিত করবে, রঙ্গ-তামশা করবে। ঝুনঝুন করে বাজাবে লাল কাঁচের চুড়ি। কুপির লাল আলো পড়বে তাদের গিন্টি-করা গয়নায়। গয়না ঝিকমিক করবে। চাঁনসোনার মতো মেয়েদের এই একমাত্র গতি।