মনিরউদ্দিনের মামি মৃত্যুকে গ্রহণ করল খুব স্বাভাবিকভাবে। তাকে দেখে মনে হল না, সে খুব-একটা মন-খারাপ করেছে। কান্নাকাটি হৈচৈ কিছুই নেই। দুঃসময়ে এক জন মানুষ কমে গেল, এই নিয়ে সম্ভবত কিছুটা খুশি। মনিরউদ্দিনকে দিয়ে গ্রামের মাতবরদের বলে পাঠাল, লেকটার কবর যেন কাঁঠালগাছটার নিচে দেওয়া হয়।
মাতবরদের একজন বজলু সরকার। লোকটি যে-কোনো কথাতেই রেগে ওঠেন। তিনি যথারীতি রেগে গিয়ে বললেন, কেন, কাঁঠালগাছের নিচে কেন?
গাছটার সাথে শেষ সময় মানুষটার দোস্তি হইছিল। নানান কথা কইত।
বজলু সরকার আকাশ থেকে পড়ল। বলে কী এইসব। সে বিস্ময় গোপন করে বলল, কী বলো তুমি? কার সাথে দোস্তি?
গাছের সাথে।
পাগল-ছাগলের মতো কথা কইবা না। আর শোন, স্বামী মারা গেল, চউক্ষে এক ফোঁটা পানি নাই—কেমন মেয়েমানুষ তুমি?
চউক্ষে পানি না-আইলে কি করমু কন?
আরে, এইটা তো মহা বেয়াদপ, মুখে-মুখে কথা কয়! এইসব কিয়ামতের নিশানা।
সত্যি-সত্যি কিয়ামতের নিশানা। পরের বৈশাখেও ফসল মারা পড়ল। পাকা ধানের খেত তিন ঘন্টার বৃষ্টিতে পানির নিচে গেল। বানিয়াবাড়ি গ্রামের মানুষগুলি পাথর হয়ে গেল। এটা কেমন কথা! আল্লাহ্র কেমন বিচার?
মৌলানা খবির হোসেন নানান জায়গায় বলে বেড়াতে লাগলেন, তিনি জানতেন এমন হবে। ধর্মের পথে কেউ নাই। জুম্মার দিনে নামাজঘরে দশটা লোক হয় না। তিনি অনেক দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। এরকম নাকি কখনো দেখেন নি।
খবির হোসেনের এ-ধরনের কথা বলার অধিকার আছে। তিনি বিদেশি লোক। বহু দেশ-গ্রাম ঘুরে এখানে এসে স্থায়ী হয়েছেন। প্রথম যখন এলেন, তখন বানিয়াবাড়ির খুব রমরমা। মাঠভর্তি পাকা ধান। বৃষ্টি-বাদলায় একটি ধানের শিষও নষ্ট হয় নি। ধান কাটা হচ্ছে। রাত জেগে মেয়েরা সেই ধান সেদ্ধ করছে। হৈচৈ, চিৎকার। খবির হোসেনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। এত ফসল ফলে ভাটি অঞ্চলে। এ দেখি আল্লাহতালার নিয়ামতের জায়গা!
তাঁর বিস্ময় দেখে বানিয়াবাড়ির লোকজন মহাখুশি। তারা দাঁত বের করে হাসে। একটা ফসল তুলি, বুঝলেন মৌলানা সাব, তারপরে পায়ের উপরে পা তুইল্যা সারা বচ্ছর খাই। ভাতের অভাব নাই।
তাই তো দেখতেছি।
এইটা হইল মৌলানা সাব ফুর্তির জায়গা। আমরা নিজেরার গানের দল আছে। বাইদ্যবাজনা হয়।
এইসব তো ঠিক না। গান-বাজনা হাদিস-কোরানে নিষেধ আছে।
চেংড়া-ফেডোরা করে আর কি। কাজকর্ম তো কিছু নাই—কি করবেন কন?
গ্রামের মুরুঝিরা বললেন, থাইকা যান মৌলানা সাব। গেরামে মসজিদ আছে। আজান দিয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন। হাদিস-কোরানের কথা কইবেন। খাওয়াখাইদ্যের কোনো চিন্তা নাই। খোরাকি বাদ দিয়াও বছরে চল্লিশ-পঞ্চাশ মণ ধান পাইবেন। বিয়া-শাদি, পালা-পার্বণে মসজিদের ইমাম সাবের জন্যে আলাদা বন্দোবস্ত আছে। বানিয়াবাড়ি জায়গা খারাপ না।
খবির হোসেন থেকে গেলেন। এরা ভুল বলে নি। জায়গা ভালোই। রাতদিন মাঠের উপর দিয়ে হু-হু করে হাওয়া বয়। মন আনচান করে। বর্ষাকালে পানিতে ঢেকে যায় চারদিক। তখন ভাটি অঞ্চলের অন্য রূপ। বিয়ে-শাদি শুরু হয়। গানের দল দিনরাত ঢোল বাজিয়ে গান করে। মহা উৎসাহে বুডোর দল ঘন্টার পর ঘন্টা খেলে বাঘবন্দি। কাজকর্মের কোনোবালাই নেই। বর্ষার সময়ে কাজ একটাই-খাওয়া এবং ঘুম। বড় বিচিত্ৰ জায়গা। খবির হোসেনের বড় পছন্দ হল ব্যাপারটা। একটা বিয়ে-শাদি করে সংসারধর্ম শুরু করার ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। জমি সস্তা। কিছু জমিজমা করা খুব কঠিন হবে না। ভাটি অঞ্চলের সস্তার ধান কিনে উজান দেশে বিক্রি করলেও ভালো পয়সা। সেটাও করা যায়, এতে দোষের কিছু নেই। স্বয়ং রসুলুল্লাহ ব্যবসাবাণিজ্য করতেন। রুজির বার আনা হল গিয়ে ব্যবসায়। হাদিসের কথা। রসূলুল্লাহ্ নিজে তাঁর সাহাবিদের বলে গেছেন।
টাকাপয়সা হওয়া দোষের না। টাকাপয়সা থাকলে মনে শান্তি থাকে। আল্লাহখোদর নাম নেওয়া যায়। পেটে ক্ষুধা থাকলে মনে ঢোকে শুধু ভাতের চিন্তা। বড় চিন্তা আসে না।
এই যেমন এখনকার অবস্থা—বড় ভালো আছেন। মনে বড় শান্তি। আল্লাহকে ডাকতে পারছেন। ইবাদত-বন্দেগি করেও আরাম পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু শেষের দু বছরের অবস্থা দেখে খবির হোসেনের মাথা-খারাপ হবার জোগাড়। এ কী সর্বনাশের জায়গা। ইয়া মাবুদে এলাহি, ইয়া গাফুরুর রহিম। সমস্ত ফসল একসঙ্গে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই ধারণাই তাঁর মাথায় আসে নি। পরবর্তী ফসলের জন্যে এই লোকগুলির আরো একটা বৎসর অপেক্ষা করতে হবে। এরা এখানেই থাকবে। অন্য কোন কাজকর্মের ধান্ধায় ঘর ছেড়ে বেরুবে না। কারণ, অন্য কাজকর্ম তাদের জানা নেই। উজানের দেশ থেকে ধুরন্ধর সব লগ্নিকারী টাকা নিয়ে আসবে। লগ্নি করবে পরের বছরের জন্যে। এক মণ ধানের টাকায় চার মণ ধান দিতে হবে। খবির হোসেন গত বৎসর এই জিনিস হতে দেখেছেন। এই বৎসরও দেখবেন। তারপর যদি সামনের বৎসরও ফসল না হয়, তখন?
মৌলানা সাহেব রোজ চিন্তিত মুখে বজলু সরকারের কাছারিঘরে বসে থাকেন। কারণ এই অভাবের দিনে তাঁর খাবার যায় এই বাড়ি থেকে। বজলু মিয়াকে তুষ্ট রাখা দরকার। বজলু মিয়া তুষ্ট হন না। বিরক্ত স্বলে বলেন, রোজ আইসা বইস্যা থাকেন, ক্যান?
কই যামু, কন?
মৌলানা মানুষ, মসজিদে গিয়ে বইস্যা থাকেন। আল্লাহ-খোদারে ডাকেন।
বড় অসুবিধার জায়গা ভাই এইটা। একটা মোটে ফসল। ফসল গেল তো সব। গেল। কী নাশের কথা।