তুই কান্দস ক্যান? তোর তো কিছু হয় নাই।
শরিফা গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। মনিরউদ্দিন তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের দিকে। শরিফা পানি এক জায়গায় ফেলতে পারে নি। চারদিকে ছড়িয়েছে। ফোস্কা পড়ে গেছে সেসব জায়গায়। অসহ্য যন্ত্রণা! কিন্তু এই যন্ত্রণার ভেতরও একটি ক্ষীণ আশার ব্যাপার আছে। সাপের কামড়ের জায়গাটি থেকে ক্ষীণ একটি রক্তের ধারা নেমে যাচ্ছে। জমাট বিষ বেরিয়ে যাচ্ছে। মনিরউদ্দিন ক্লান্ত গলায়। বলল, একটা পাখা আন্। হাওয়া করু।
প্রয়োজনের সময় কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। তালের পাখা বিছানায় নিয়ে শুয়েছিল, সেটি এখন কোথাও নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার। এটা যাবে কোথায়?
শরিফা।
কি?
করতাছস কি?
পাখা খুঁজি।
বাদ দে।
শরিফা দরজা ধরে অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়াল। তার গালে পানির দাগ এখনো শুকায় নি।
রোদ উঠে গেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এই বাড়িতেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।
মনিরউদ্দিন হঠাৎ করেই অসম্ভব নরম গলায় বলল, আমার এক মামি আছিল-চাঁনসোনা নাম। তোর মতো সুন্দর আছিল। বাঞ্জা মাইয়ামানুষ। পুলাপান ছিল না।
শরিফা ভেবে পেল না, হঠাৎ মামির কথা আসছে কেন।
শরিফা।
কি?
মামিটা বড় ভালো আছিল। মজার শিলুক দিত।
হঠাৎ তার কথা কন ক্যান?
কোনো কারণ নাই। এমনে মনে হইল। এক গেলাস পানি দে। তিয়াষ হইতাছে।
শরিফা পানি এনে দিল। মনিরউদ্দিন পানি খেতে পারল না। এক ঢোক খেয়েই বলল, পানি তিতা লাগছে।
রক্তশূন্য হয়ে গেল শরিফার মুখ। কী সর্বনাশের কথা! পানি তিতা লাগবে কেন?
মনিরউদ্দিনের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। দড়ি দিয়ে বাঁধা পা অনেকখানি ফুলে উঠেছে। সে থেমে-থেমে শ্বাস নিচ্ছে, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বড় আদর করত আমারে।
কার কথা কন?
আমার মামি। চাঁনসোনা নাম। আমার জীবনা কষ্টে গেছে, বুঝছস শরিফা। খুব কষ্টে।
শরিফা তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বড়-বড়। সেখানে পানি টলটল করছে। সাদা মোরগটি এগিয়ে আসছে। এর কৌতূহল অন্যদের চেয়ে বেশি।
শরিফা। আমার মামি বড় সুন্দর-সুন্দর কথা কই।
জ্বি।
মনিরউদ্দিনের কথা। জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশাল একজন মানুষ কেমন শিশুদের ভঙ্গিতে কথা বলছে।
মাইয়ামাইনষের উপরে গোস্বা
মামি সবসময় বলত–মাইয়ামাইনষের উপরে গোস্বা করবি না। এরা উলটাপালটা কাম করে। বুদ্ধি-কম জাত, কি করবি?
মনিরউদ্দিন মামি যা বলত তাতেই মাথা নাড়ত। কারণ তার তখন চরম দুঃসময়। মনে ভয় ঢুকে গেছে। মনে হচ্ছে মামিও তাকে দূর করে দেবে। একদিন কাছে ডেকে এনে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলবে, আকালের দিন পড়ছে রে বাপ! একটা বাড়তি পেটের জায়গা নাই। তুই অন্য জায়গা দেখ।
এই বলে সে খানিকক্ষণ কাঁদবে খুনখুন করে, তারপর একটা চকচকে সিকি হাতে ধরিয়ে দেবে। সাত বছর বয়সের মনির মিয়াকে তার ইহজাগতিক সম্বল একটি লুঙ্গি এবং একটি গামছা কাঁধে নিয়ে নতুন আশ্ৰয় খুজতে হবে। কোথায় খুঁজবে সে? খোঁজা হয়ে গেছে। কোথাও আর কেউ নেই।
কিন্তু মামি চরম আকালের দিনেও তাকে বের করে দেয় নি। উঠতে-বসতে এক শ কথা শোনায় নি। বরং আড়ালে-আবডালে ডেকে নিয়ে বলেছে, মাটি কামড় দিয়া পইড়া থাক। তোর মামা মাইরধর করব, খেদাইয়া দিতে চাইব। পুলাপান মানুষ তুই, যাইবি কই? খাইবি কী? আমি যত দিন আছি, তুইও থাকবি।
কী ভয়াবহ দুৰ্দিন। বৈশাখের ফসল মারা গিয়েছে। নাবাল অঞ্চলের ফসল এই একটিই। মানুষ খাবে কী?মনিরউদ্দিনের মামা চোখ লাল করে সারা দিন উঠোনে বসে থাকে। তার দিকে তাকালেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় মনিরউদ্দিনের। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, মামা তাকে কিছু বলে না। সংসারের তিনটিমাত্র পেট পালতে গিয়ে লোকটি দিশাহারা হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড গরমে খা-খ করে গ্রাম। মনিরউদ্দিন দুপুরে একা-একা ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি ফিরলেই আমি ফিসফিস করে বলে, অত হাঁটাহাঁটি করিস না। হাঁটাহাঁটি করলেই খিদা লাগব। খিদা লাগলে খাবি কী? পাতিল ঠনঠন।
সেই এক বৎসরেই মামা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল। অসুখবিসুখে শরীরও নষ্ট। মুনিষের কাজ, ঘরামির কাজ কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কাঁঠালগাছের নিচে একটা চাটাই পেতে সারা দিন শুয়ে থাকে। বিড়বিড় করে সারা দিন কথা বলে কাঁঠালগাছের সঙ্গে। মজার-মজার কথা। হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে বলে আর হাসে। মাঝেমাঝে চুপ করে থাকে, তখন তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে কথা শুনছে। লোকজন অবাক হয়ে দেখতে আসে। সে নির্বিকার। মনিরউদ্দিনও দেখে চোখ বড়-বড় করে, কাছে যেতে সাহস পায় না।
মামি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, মানুষটার মাথা-খারাপ হইছে বুঝছস মনির মিয়া? গাছের সাথে দোস্তি। রাইজ্যের আলাপ করে গাছের সাথে। কী সব্বনাশের কথা ক দেখি।
এই বলেই সে হাসে খিলখিল করে। মনিরউদ্দিন বুঝতে পারে না, তার হাসা। উচিত কি না।
ও মনির মিয়া, লোকটা পাগল হইলেও কিন্তু খারাপ না কি কস? এই যে অত দিন থাকলি—একটা কথা হইছে? অন্য কেউ হইলে লাথ দিয়া বাইর কইরা দিত। দিত কি না?
দিত।
পেটের খিার মতো খারাপ জিনিস নাই। বাঘেরা পেটে যখন খিদা ওঠে, তখন কী করে জানস?
না।
নিজের বাচ্ছা খায়। বিলাইও নিজের বাচ্ছা খায়। নিজের চউক্ষে দেখা। আল্লাহর কিরা।
মামার চিকিৎসা কিছু হল। গ্রাম্য চিকিৎসা। মাথা কামিয়ে খালিশপুরের পীর সাহেবের তেল-পড়া। তাতে লাভ হল না। শুধু মামার মুখটা শিশুদের মুখের মত হয়ে গেল। লোকটা মারা গেল ভাদ্র মাসে। যথারীতি গাছের নিচে শুয়ে ছিল। সন্ধ্যাবেলা রুটি আর ডাল নিয়ে খাওয়াতে গিয়ে দেখা গেল শক্ত হয়ে পড়ে আছে। মুখ হাঁ-করা। অসংখ্য লাল পিপড়া সারিবদ্ধভাবে মুখের ভেতর ঢুকছে এবং বের হয়ে আসছে।