শরিফা বিড়ি এনে দিল। মনিরউদ্দিন লক্ষ করল শরিফার ব্লাউজের একটি বোতাম এখন খোলা, অথচ মোটেও লক্ষ নেই এদিকে। সকালে একবার বলেছিল, তারপরও হুঁশ হয় নি। একবার ভাবল এই নিয়ে কিছু বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না। হঠাৎ করে পায়ে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে। এ-ব্যথা আগের মতো না। অন্য রকম ব্যথা। মনিরউদ্দিন বিড়ি ফেলে দিয়ে চেচিয়ে কেঁদে উঠল। সমস্ত দিনের মধ্যে এই প্রথম সে কাঁদল। অন্তু মিয়ার বুড়ো ছাগল ঘরে ঢুকে তাকিয়ে আছে মনিরউদ্দিনের দিকে।
শরিফা।
কি?
আমার মামি যদি কোনোদিন ফিইরা আসে, যত্ন করিস। জলচৌকির উপরে বসাইয়া পাও ধুইয়া দিস। নিজের হাতে পাও ধুয়াইবি। মামির জইন্যে মন কান্দে।
আপনের শইল কি বেশি খারাপ?
মনিরউদ্দিন জবাব দিল না। শরিফা যেখানে বসে ছিল, সেখানেই বসে রইল। তার গালে জলের সূক্ষ্ম দাগ। সে তাকিয়ে আছে কুপির দিকে। কেমন লালচে দেখাচ্ছে তার মুখ।
শরিফা।
কি?
অন্তু মিয়ার কথা যেটা কইলাম মনে রাখিস। ভুল হয় না যেন। টাকা বড় জিনিস না। মায়া-মহতটা বড় জিনিস। পাঞ্জাবিটা ভাল জমিনের কিনবি।
শরিফার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। মনিরউদ্দিন ধরা গলায় বলল, আর শোন্ শরিফা, আমার উপরে কোনো রাগ রাখিস না।
এইডা কী কন?
মনিরউদ্দিন বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাশল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত থেকে জ্বলন্ত বিড়ি পড়ে গেছে। কিন্তু না, সে ঘুমুচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নড়েচড়ে উঠল। অস্পষ্ট গলায় ডাকল, শরিফা, ও শরিফা।
কি?
খবির হোসেন লোকটারে মান্য করবি। ভালো লোক।
আফনে চুপ কইরা থাকেন। এট্টু বাতাস করি?
মনিরউদ্দিন হ্যাঁ-না কিছুই বলল না।
মাগরেবের নামাজের আজান
খবির হোসেন মাগরেবের নামাজের আজান দিলেন এবং বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন, বেশ কিছু লোকজন আসছে। তাঁর মন আনন্দে পূর্ণ হল। একটি লাইন পুরো হলেও মনে শান্তি। এক জনের কথা আল্লাহ্ না-শুনতে পারেন, কিন্তু দশ জন মানুষ একত্রে দাঁড়ালে অন্য রকম জোর হয়। নামাজ পড়িয়েও আনন্দ।
অজুর পানি তোতা নেই, এটা একটা সমস্য হতে পারে। সবাই এসে অজু করতে চাইবে, এবং বিরক্ত হবে। পরে অন্য এক দিন যখন নামাজে যেতে ইচ্ছা করবে তখন যাবে না এই অজুহাতে যে, অজুর পানি নেই। মানুষের অজুহাতের শেষ নেই। এরা অন্ধকার থেকেও অজুহাত খুঁজে বের করে।
খবির হোসেন আজান শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। না, লোকগুলি তাঁর এখানে আসছে না। উত্তরের রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? মনিরউদ্দিনের বাড়ির দিকে কি? মনিরউদ্দিনের কিছু হয়েছে নাকি?
শক্ত বাতাস দিচ্ছে। মেঘ উড়ে-উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। এখন পর্যন্ত বৃষ্টির একটি ফোঁটা পড়ে নি। এরকম কিছুক্ষণ চললে হয়তো আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঝকঝকে তারা উঠবে। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলেই তাঁর বান্দার উপর অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। বান্দারা অন্ধ বলে সেটা টের পায় না। ফাবিয়ায়ে আলা রাৰিকুমা তুকাজজিবান। আল্লাহপাকের নিয়ামত অস্বীকার করার কোন পথ নেই। এই অনন্ত আকাশ, শস্যের বিশাল মাঠ, জলভরা নদীসবই তাঁর দান।
নামাজে দাঁড়িয়ে খবির হোসেনের মনে হল, তিনি কান্নার শব্দ শুনছেন। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই মনের ভুল। মনিরউদ্দিনের বাড়ি অনেকটা দূরে। এতদূর থেকে কান্নার শব্দ আসার কথা নয়। এটা অন্য কোনো শব্দ। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, সেই আনন্দে হয়তো দল বেঁধে সবাই বের হয়েছে। আবার খবির হোসেনের নামাজের গণ্ডগোল হল। রুকুতে না-গিয়ে সেজদায় চলে গেলেন। শয়তান চলাফেরা করে রক্তো সে-ই এইসব করাচ্ছে। তুচ্ছ জাগতিক বিষয়ে তাঁর মন ফিরিয়ে আনছে। হে আল্লাহপাক, হে করুণাময়, তুমি শয়তানের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর।
কিন্তু কান্নার শব্দটি সত্যি-সত্যি আসছে। এর মানে কী? কে কাঁদবে?
কাঁদছিল অন্তু মিয়া
কাঁদছিল অন্তু মিয়া।
সে খবর পেয়েই রওনা হয়েছে। তার শরীরটা ভালো না। মসজিদের কাছাকাছি। এসে আর চলতে পারছে না। রাস্তার পাশে বসে শব্দ করে কাঁদছে। এবারও সে খালিহাতে আসে নি। তার লুঙ্গির খুঁটে কাঁচা সুপারি। বোনের জন্যে নিয়ে এসেছে। এরকম ভয়াবহ দুঃসংবাদ পাওয়ার পরেও সুপারিগুলি সে জোগাড় করেছে। শিশুরা পৃথিবীর কোনো দুঃসংবাদই স্বীকার করে না।
খবির হোসেন বললেন, তুমি কে?
কোনো জবাব এল না।
তুমি কি এই গেরামের?
না।
নাম কি তোমার?
অন্তু মিয়া।
ও আইচ্ছা, চিনলাম। পথের মইধ্যে বইসা কানতে ক্যান? ধর, আমার হাত ধর। চল আমার সঙ্গে। আমারে চিনছ?
অন্তু খবির হোসেনের হাত ধরল। রোগা একটা হাত। কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে। কেঁপে উঠছে। খবির হোসেন গভীর মমতায় বললেন, ও বাঁইচ্যা আছে। কিছু হয় নাই। কিছু হইলে খবর পাইতাম। মরণের খবর পাইতাম। মরণের খবর গ্রামের ইমাম পায় সবার আগে। বুঝলা? ধর, শক্ত কইরা আমার হাত ধর। তামার খুঁটের মইধ্যে কি?
সুপারি।
বোনের জইন্যে আনছ?
অন্তু মিয়া মাথা নাড়ল এবং অন্য হাতের তালুতে চোখ মুছল।
মনিরউদ্দিনের বাড়ির সামনে একটি গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জলিল নিয়ে এসেছে। মনিরউদ্দিনকে গঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। অনেক লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। বেশ বড় একটা জটলা। গ্রামের মাতবর শ্রেণীর লোকজনও সবাই আছে। বজলু সরকার ভারি গলায় নির্দেশ দিচ্ছেন। উঠোনে তিন-চারটা হারিকেন এবং কুপি। তাতেও ঠিক আলো হচ্ছে না।