অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
মাজানের শরীর?
এবারও সে মাথা নাড়ে। মুখে তার কথা নেই।
যা দু-একটা বলে, তা এতই ক্ষীণ স্বরে, শরিফা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না। সে কখনই খালি হাতে আসে না। কিছু-না-কিছু থাকেই তার সঙ্গে। অতি সামান্য জিনিস-এক হালি ডিম, আধ সের দুধ, একটা ছোট কাঁঠাল। এতেই শরিফার চোখে আনন্দে পানি এসে যায়। বাপের বাড়ির জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কতভাবে দেখে—এইটা কোন গাছের কলা রে? বিছারা তলার?
হুঁ।
নে, তুই খা।
না, তুমি খাও।
তৎক্ষণাৎ কলা ছিলে খেতে বসে শরিফা। তার বড় ভালো লাগে।
গুড়ের লাহান মিছা।
আরেকটা খাও।
না, থাউক। তোর দুলাভাইরে দিমু
অন্তু মিয়ার নিজের কিছু সম্পত্তিও এ-বাড়িতে থাকে। যেমন বুড়ো.ছাগল এবং লাল মুরগি। বুড়ো ছাগলটিকে সে এনে রেখেছে। কারণ সে টের পেয়েছে, ছাগলটিকে তার মা বিক্রি করে দেবে। চৈত্র মাসের অভাবে দরিদ্র কৃষকদের ছাগল-মুরগি সবই চলে যায়।
বোনের বাড়িতে এই ছাগলটি থাকায় অন্তু মনে খুব শান্তি পায়। বিক্রি হওয়ার ভয় নেই। এই অঞ্চলে চৈত্র মাসের অভাব এত প্রকট নয়। অন্তু মিয়া সারা দিন বোনের পেছনে-পেছনে ঘুরে রোদ পড়তেই আবার রওনা হয়ে যায়। রাতে সেকিছুতেই থাকবে না।
মনিরউদ্দিন বলে, চৈত্র মাসের এমন কড়া দিনে এত ঘন-ঘন আওন ঠিক না। অসুখে পড়ব। অন্তু মিয়ারে নিষেধ করব।
শরিফা ক্ষীণ স্বরে বলে, নিষেধ করি। ভাতের লোভে আয়। মার বাড়িত ভাত নাই। রুটি খায়।
বড় মায়া লাগে মনিরউদ্দিনের। ভাতের লোভ দুদিন পরপর ছেলেটা আসে। সে যখন অন্তু মিয়ার মতো ছিল, তখন কী ভয়ংকর অভাব। ভাতের লোভে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেত।
শরিফা।
কি?
ভালো কইরা খাওয়াইবা অনুরে। থালা ভইরা গরম ভাত দিবা। গাওয়া ঘি আছে? থাকলে পাতের কিনারায় দিবা মনে কইরা। ভুল হয় না যেন।
ভাত খাওয়ার সময় মাঝে-মাঝে মনিরউদ্দিন বসে অন্তুর সামনে। ক্ষুধার্ত বালকটির খাওয়া দেখতে তার ভালো লাগে। অন্তু মনিরউদ্দিনকে বড় ভয় পায়। সহজভাবে তার সামনে খেতে পারে না। শরিফা বলে, আপনের সামনে অন্তুর খাইতে শরম লাগে।
শরম? শরমের কী আছে? খাওনের মইধ্যে শরম কিছু নাই। লও, আর চাইরডা ভাত লও। তেঁতুল দিয়া মাইখ্যা খাও।
অন্তু মিয়া হাঁসের মতো গলা টেনে-টেনে ভাত খায়। মনিরউদ্দিন দরাজ গলায় বলে বসে, এইবার ঈদে তোমারে টুপি আর পাঞ্জাবি দিম। কচুয়া পাঞ্জাবি আর সাদা টুপি। না তুমি সাদা পাঞ্জাবি চাও?
অন্তু মুখভর্তি ভাত নিয়ে কোনোমতে বলে, কচুয়া।
আইচ্ছা ঠিক আছে, কচুয়া।
অন্তু মিয়া তার কচুয়া পাঞ্জাবির কথা ভোলে না। যত বারই আসে, শরিফার কাছে খোঁজ নিয়ে যায় দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবির কথাটা মনে আছে কি না। মনে না-থাকলে যেন মনে করিয়ে দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবিটা কেনা হয় না। শরিফার জন্যে একটা মোটাপাড় শাড়ি, সংসারের দুই-একটা টুকিটাকি কিনে, টাকার টান পড়ে যায়। বড় ঈদে কিনে দেওয়া যাবে এই ভেবে বাড়ি ফেরেমনিরউদ্দিন। অন্তুর জন্যে বড় মায়া লাগে। সে দুপুরের কড়া রোদে হেঁটে এসেছে পাঞ্জাবির জন্যে। ছেলেমানুষ সে, সংসারের টানাটানি এখনো বোধহয় সেরকম বোঝ না।
বড় ঈদে কিন্যা দিমু, বুঝলা অন্তু।
জি আইচ্ছা।
মনিরউদ্দিন গম্ভীর গলায় বলল, বড় ঈদে না কিন্যা দিলে আমি বাপের পুত না। বড় ঈদ তুমি আমরার সাথে করবা।
জ্বি আইচ্ছ্যা।
এক দিন আগে চইলা আইবা। একত্রে জামাতে যামু।
জ্বি আইচ্ছা।
বড় ঈদে অন্তু এক দিন আগে ঠিকই আসে। পাঞ্জাবি পায় না। সেসময় মনিরউদ্দিনের বড় দুঃসময়। একটা পয়সা হাতে নেই।
খুব শরমিন্দা হইলাম তোমার কাছে অন্তু মিয়া। গরিব হওন বড় শরমের ব্যাপার।
জামাতের সময়টায় মনিরউদ্দিন মুখ অন্ধকার করে কাঁঠালগাছের নিচে বসে থাকে। নামাজে যেতে ইচ্ছা করে না। শরিফাকে এসে বলে, নামাজে যামু না ঠিক করলাম।
শরিফা চোখ কপালে তুলে বলে, কী সৰ্বনাশের কথা কন!
ঈদের নামাজ গরিবের জন্যে না।
আল্লাহ-নারাজ কথা কইয়েন না। অন্তরে লইয়া নামাজে যান। আর আপনে মনটা অত খারাপ করছেন ক্যান? ঈদ তো শেষ হয় নাই। আরো তো ঈদ সামনে আছে।
কুপি জ্বলছে। তার লাল শিখার সামনে শরিফা বসে আছে নতমুখে। তার নাকের সবুজ ফল অসম্ভব সুলস্থুল করছে। নাকফুলটার দিকে তাকিয়ে আছে মনিরউদ্দিন। দরজার কাছে অন্তু মিয়ার বুড়ো ছাগল। সে মাথাটা ঢুকিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিল যে সে, এসেছে, তবে এই মুহূর্তে ঘরে ঢোকার ইচ্ছা নেই। লাল মুরগিটিও ঘরের ভেতর এক পা দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। অন্য মুরগিটাও তাই করল। এরা শরিফার ডাকের অপেক্ষা করে। না-ডাকা পর্যন্ত ঘরে ঢুকবে না, বারবার উঁকি দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবে।
মনিরউদ্দিন মৃদু সুরে ডাকল, শরিফা।
কি?
সিন্দুকের মইধ্যে দুই শ টাকা আছে। তুই জানস?
জানি।
যদি আমার কিছু হয়, ঐ টেকাডি দিয়া পইলা একটা কাম করিস।
শরিফা ঠাণ্ডা গলায় বলল, কি কাম?
অন্তু মিয়ারে একটা পাঞ্জাবি, পায়জামা আর টুপি কিইন্যা দিবি।
শরিফা কিছুই বলল না। দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। মনিরউদ্দিন নরম গলায় ডাকল, শরিফা।
কি?
কান্দস ক্যান? কাইলা কিছু হয় না। কান্দিস না। আমার মনে হয় না আমার কিছুহইব। অতক্ষণ যখন টিইক্যা আছি। কিছু হওয়ার হইলে এর মইধ্যে হইত। অখন শইডা ভালোই লাগছে।
পাওডাত ব্যথা নাই?
আছে। ব্যথা আছে। সাপের বিষ সহজ জিনিস তোনা। কঠিন জিনিস। একটা বিড়ি দে। তোষকের নিচে আছে।