মতির মা নাম বলল না
বসল। তার নিজের নামের কি কোন খোঁজ আছে? তাদের মতো মানুষদের নিজের নাম থাকে না। ভাগ্যিস মতি বলে একটা মেয়ে ছিল। লোকজন সেই মেয়ের নামে তাকে ডাকে। মরা মেয়েটার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়।
কোন বাড়ি তোমার?
বাড়িঘর নাই।
পান আছে? চুন বেশি কইরা দিয়া একটা পান খাওয়াও গো ভালো মাইনষের ঝি।
মতির মা পান আনতে গেল। লোকটার সঙ্গে বসে গল্প করতে ভালো লাগছে। এই লোকটির সঙ্গে তার মৃত স্বামীর কোথায় যেন একটা মিল আছে। ঐ মানুষটাও বড়বড় নলা করে ভাত মাখত। এমনিতে কথাটথা বলত না, কিন্তু একটু ভালো খাওয়াখাদ্য হলেই শুরু হয়ে যেত বকবকানি। তার গল্প মানেই খাওয়ার গল্প। মাশুল মাছ খেয়েছিল নাকি কোথায়, তার স্বাদের কোন তুলনা নেই। চোখ বড়-বড় করে বলেছে—দুনিয়ার মইধ্যে মাছ বলতে একটা মাশুল মাছ। হাড়েগুড়ে মিডা।
মিডা? মিছা মাছের আবার স্বোয়াদ কি?
না খাইলে বুঝবি না।
আন একদিন, খাইয়া দেখি।
দেখি, যদি পাই।
খাওয়া-খাদ্যের গলে ঐ লোটার কোনো ক্লান্তি ছিল না। মতির মা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে পান নিয়ে বের হয় এল। বাঁশের দরজায় হেলান দিয়ে নিবারণ ঘুমুচ্ছে। গাঢ় ঘুম। নিবারণের মুখ হাঁ হয়ে আছে। লাল টুকটুক জিভ অল্প-অল্প নড়ছে। মতির মা তাকে ডাকল না। পানের বাটা সামনে রেখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তাকে যেতে হবে নিয়ামত খাঁর বাড়ি। অনেক কাজ সেখানে। ধান সেদ্ধ হচ্ছে। সেদ্ধ ধান ঘরে নেওয়া হচ্ছে। কাজের মেয়ে অনেক আছে। আরো দরকার। নিয়ামত শার বড় তরফের বৌ তাকে হাত ধরে বলেছে-দির করিস না। ভাতের গামলা থুইয়াই দৌড় দিয়া আসবি। মতির মার যেতে ইচ্ছা করছে না। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো ব্যাপার তার জীবনে দীর্ঘদিন ধরেই নেই। তাকে যেতেই হবে। শরিফা মেয়েটা একা-একা থাকবে। এমন দুঃসময়ে কাউকে একা থাকতে দেওয়া ঠিক না। কিন্তু এই সংসারে ঠিক কাজটা কখনো হয় না। বেঠিক কাজই সব সময় হতে দেখা যায়। জগৎ-সংসারের এইটাই নিয়ম। মতির মার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। পানি আসার কোনোই কারণ নেই। কেন এরকম হল কে জানে।
সে আর ঘরে ঢুকল না—সেখান থেকেই ক্লান্ত গলায় বলল, ও শরিফা, আমি গেলাম। সইন্ধার পর আসমু।
মতির মা উঠোনে নেমেই টের পেল, বাতাস দিচ্ছে। বেশ ভালো বাতাস। এই বাতাস কি মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে? মতির মা আকাশের দিকে তাকাল।
শরিফা ঘরে একটা কুপি জ্বালিয়েছে। সন্ধ্যা মেলানোর আগে কুপি ধরানো অলক্ষণ। এখন যেমন অন্ধকার করেছে, কুপি জ্বালানোয় নিশ্চয়ই দোষ হবে না। মনিরউদ্দিন বালিশে ঠেস দিয়ে কুপির আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। শরিফা বসে আছে কুপির সামনে। মনিরউদ্দিন লক্ষ করল, শরিফার নাকে সবুজ রঙের পাথর-বসানো একটা নাকফুল। গাইনবেটিদের কাছ থেকে কিনেছে বোধহয়। গাইনবেটিরা ফসল তোলার আগেই ডালা সাজিয়ে একবার আসে। পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলে কিনেন। গগা ভইন। বালা সদাই। দামের চিন্তা নাই। ধান উঠুক।
গ্রামের বোকাসোকা মেয়েগুলি স্বামীকে লুকিয়ে জিনিসপত্র কিনে ঘর বোঝই করে। তরল আলতা, ফিতা, রাং, কাঁচের চুড়ি, পাউডার, কাজল, লক্ষ্মীবিলাস তেল, স্বামী-সোহাগী সাবান। জিনিস কেনার ব্যাপারে শরিফার হাত খুব দরাজ। যাই দেখবে কিনে ফেলবে।
গত বার কিনেছে পেলেন চিলুমচি। সেখানে তার নিজের নাম লেখা। ফুল লতাপাতা আঁকা। এক কাঠা চাল দিতে হয়েছে চিলুমচির জন্যে। এসব জিনিস দেখেও না-দেখার ভান করতে হয়। মেয়েজাতের নিয়মই হচ্ছে অবিবেচকের মতো কাজ করা। তবু মাঝেমধ্যে নিয়মরক্ষার জন্যে দু-একটা কড়া কথা বলতে হয় বলেই মনির বলল, খামাখা চিলুমচি কিনলা ক্যান?
শরিফা এঁকেবেঁকে বলল, আমার নাম লেখা আছে। আমার সামনে লেখছে।
কই, দেখি!
শরিফা আগ্রহ করে দেখাল।
সত্যি-সত্যি কী-সব যেন লেখা। নামই হবে।
বাজে-খরচ মোটেই করবানা, বুঝলা। এই বাজে-খরচ আমার পছন্দনা। বাজে। খরচে সংসার নষ্ট।
বলেই মনিরউদ্দিনের মনে হল, কথাগুলো বেশি কড়া হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে উদাস গলায় বলল, চিলুমচির অবশ্যি দরকার। ময়-মেহমান আসলে খাতির-যত্ন করতে হয়। না, ভালোই করছ।
শরিফা ক্ষীণ স্বলে বলল, আমার নাম লেখা আছে। চুরি হইত না।
তাও ঠিক, চিহ্ন আছে। ভালো হইছে। সিন্দুকে তুইল্যা থও। মাঝেমধ্যে তেঁতুলের পানি দিয়া মাজবা।
শরিফার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে তৎক্ষণাৎ তেঁতুলের পানি নিয়ে মাজতে বসে, এবং ঝকঝকে জিনিসটি গভীর মমতায় তুলে রাখে সিন্দুকে। যদি কোনো দিন মেহমান আসে, তা হলে এই জিনিস বেরুবে সিন্দুক থেকে।
মেহমান কেউ মনিরউদ্দিনের বাড়িতে আসে না। শুধু কিছুদিন পরপর আসে শরিফার ছোট ভাই অন্তু মিয়া। অন্তু মিয়ার বয়স এগার। অসম্ভব রোগা। সমস্ত শরীরের ভেতর বড়-বড় দুটি চোখ ছাড়া কিছুই নজরে পড়ে না। মাথা পরিষ্কার করে কামানো। সবুজ রঙের একটা লুঙ্গি এবং বেশ পরিষ্কার একটা গেঞ্জি পরে সে প্রায়ই ধুলো পায়ে সাত মাইল হেঁটে বোনের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে উঠোনেই বসে পড়ে। আর দু পা হেঁটে ঘরে ঢোকারও যেন সামর্থ্য নেই। বড়-বড় নিঃশ্বাস নেয়। দেখে মনে হয়, এই বুঝি দম আটকে এল। শরিফা ছুটে গিয়ে এক বদনা পানি ভাইয়ের মাথায় ঢালে। অন্তুর খানিকটা আরাম হয়। শরিফা জিজ্ঞেস করে, শরীর ভালো?