আকাশে গুড়ুগুড়ু মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মেঘের পরে মেঘ জমছে, অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, বৃষ্টির ফোঁটাও এখনো পড়ে নি।
তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করে ফিরাইলের দিকে তাকালেন। হাত তুলে অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি করছে লোকটা। রাগে গা জ্বলে যায়। এই চেংড়াকে আনাই ভুল হয়েছে। এসব কি চেংড়া-ফেংড়ার কাজ।
উজানের কামলাদের একজন কিসে যেন খুব মজা পেয়েছে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। অন্যরা ধান কটা বন্ধ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বজলু সরকার এগিয়ে গেলেন। কামলাটি হাসিমুখে বলল, সরকার সাব, কুদ্দুসের কথা হুনছেন। কুদ্দুস কয় কি……
বজলু সরকার তাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। প্রচণ্ড একটি লাথি বসিয়ে দিলেন। লোকটি ধানখেতে গড়িয়ে পড়ল। সরকার সাহেব নিজের জায়গায় ফিরে এলেন।
হতভম্ব কামলাটি উঠে বসেছে। সে সঙ্গীদের দিকে তাকাচ্ছে সমর্থনের আশায়। কিন্তু সঙ্গীরা আবার কাজ শুরু করেছে, যেন কিছুই হয় নি।
নিয়ামত খাঁ মাঠে আসেন নি। এ ছাড়া আর সবাই আছে। খাঁ সাহেব কেন আসেন নি বোঝা যাচ্ছে না। শরীর খারাপ বোধহয়। তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। ছেলে নেই, দুটিমাত্র মেয়ে। মেয়ের জামাইরা এখনই কোন্দল শুরু করেছে। জমির ভাগাভাগি কী হবে, এ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা। জামাই দুটিই হচ্ছে মহা হারামজাদা। বজলু সরকার এক জনকে লক্ষ করলেন। বেশ প্যান্ট-শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে। চোখে কালো চশমা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল, বজলু সরকারকে দেখে ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে এল এবং শুদ্ধ বাংলায় বলল, চাচাজীর শরীরটা ভালো তো?
শরীর ভালই। তোমার শরীর কেন?
আছি কোনোমতে।
এইখানে আইছ কি জইন্যে? রঙ্গ-তামশা দেখতে?
জ্বি, কি বললেন?
এইটা রঙ্গ-তামশা দেখনের সময় না। তুমি গেরামের জামাই। যদি জামাই না হইতো, তা হইলে তোমারে ধান কাটতে লাগাইয়া দিতাম।
জামাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রাইল। নিয়ামত খাঁর জামাইকে এত বড় কথা বলাটা ঠিক হয় নি, কিন্তু বজলু সরকার বেশ ভেবেচিন্তেই বলেছেন। এই বিদেশি ছেলেটির সঙ্গে তিনি একটি বিরোধ তৈরি করতে চান। তিনি চান না, এখানেই সে স্থায়ী হোক। বাইরের লোকজন এখানে আস্তানা গাড়ুক, তা তিনি চান না। এ ছাড়া এই শার্ট-প্যান্ট-পরা যুবকটির সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করায় একটু আগে তিনি লাথি বসিয়ে যে-অন্যায়টি করেছিলেন, তা খানিকটা কমবে। যে খেয়েছে, সে বুঝবে, এই লোকটি কাউকে রেয়াত করে না। তাঁর স্বভাবই এমন। বজলু সরকার সব কাজই খুব ভেবেচিন্তে করেন। বড় হতে হলে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হয়। তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা এবং নিজের বুদ্ধিতে বিশাল সম্পত্তি করেছেন। জলমহাল করেছেন। এইসব এমনি-এমনি হয় না। সম্পত্তি করা খুব কঠিন নয়। বজায় রাখাটাই কঠিন।
বজলু সরকার লক্ষ করলেন, নিয়ামত খাঁর জামাই মুখ কালো করে চলে যাচ্ছে। যাক, আপদ বিদায় হোক। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে একটি গভীর ক্ষত আছে। বিপুল বিষয়-সম্পত্তি করেছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো পুত্ৰ-কন্যার মুখ দেখতে পারেন নি। তাঁর তিন স্ত্রীর প্রতিটিই অপদার্থ। আরেক বার চেষ্ট করা যায়। কিন্তু কেন জানি আর কোনো আগ্রহ বোধ করেন না। রক্তের তেজ মরে গেছে।
বজলু সরকার লক্ষ করলেন, ফিরাইল তাঁর দিকে দ্রুত আসছে। কি বলতে চায় কে জানে? তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলতে ভালো লাগে না।
সরকার সাব।
বলেন।
একটা কথা বলতে চাই আপনেরে।
বলেন। কি কথা?
কথাটা এট্টু আড়ালে করতে চাই।
যা কওয়ার এইখানেই কম। কানাকানি আমি পছন্দ করি না। কানাকানি করে। মেয়েলোকে।
ফিরাইল ইতস্তত করছেন। কথাটা যেন বলতে পারছেন না, আবার না-বলেও পারছেন না।
কি, বলেন আপনের কথা।
আপনে বাড়িত গেলে ভালো হয়। বাড়িত যান গিয়া।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
দিনের অবস্থা খুব খারাপ। আপনে থাকলে অসুবিধা হইব।
কি অসুবিধা।
যারার পুত্রসন্তান নাই, তারা মাঠে থাকলে আমার অসুবিধা। আমি ফিরাইতে পারতেছি না। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে সরকার সাব। অপরাধ নিবেন না। আপনে বাড়িত যান।
আমি চইলা গেলে তুমি ফিরাইতে পারবা?
চেষ্টা করমু। অখন চেষ্টাও করতে পারতেছি না।
কামলারা ধান কটা বন্ধ করে অবাক হয়ে ফিরাইলের কথা শুনছে। বজলু সরকার প্রথম বারের মতো তীক্ষ চোখে লোকটিকে দেখলেন। একে শুরুতে দুধের বাচ্চা বলে মনে হয়েছিল, এখন হচ্ছেনা। এ বোধহয় পারবে। বজলু সরকার হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর পা মনে হচ্ছে পাথরের মত। টেনে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
আকাশে বজের শব্দ। হালকা বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বজলু সরকার এক বারও পেছনে ফিরে তাকালেন না।
মতির মা খাবার নিয়ে এসেছে
মতির মা খাবার নিয়ে এসেছে।
এক গামলা ভাত, রুই মাছের তিনটা বড়-বড় দাগ। এক বাটি মাষকলাইয়ের ডাল। মনিরউদ্দিন তার কিছুই মুখে দেয় নি। দু-এক নলা মুখে দিয়ে থালা সরিয়ে দিয়েছে। শরিফা বলল, কি হইছে? খান না?
মুখে দেওন যায় না। তরকারিত লবণ দিছে দুই হাতে।
একটা ডিম ভাইজ্যা দেই?
না, খিদা নাই।
দেই, একটা ডিম দেই।
মনিরউদ্দিন কাল শরিফার দিকে। তার মুখ এতটুকু হয়ে গেছে। এমনভাবে ডিম ভেজে আনার কথা বলছে যে, মনিরউদ্দিন না বললে সে কেঁদে ফেলবে।
শরিফা আবার বলল, লবণ ছাড়া ভাইজ্যা দেই?
আচ্ছা দে।
সেই ডিমও মনিরউদ্দিন খেতে পারল না। মতির মা ভাত-তরকারি দিয়ে এল নিবারণকে। নিবারণ এমনভাবে খাচ্ছে, যেন সে দীর্ঘদিনের উপবাসী। মতির মা লম্বা ঘোমটা টেনে পাশে বসে আছে। নিবারণ বলল, তরকারি ভালো হইছে। পুঙ্কুনির রুই মাছ-এর বোয়াদই আলাদা। নদীর রুই মাছ অত স্বােয়াদ হয় না। নাম কি তোমার?