হাতেরডা দ্যান।
জলিল বিড়ির টুকরাটা ছুঁড়ে দিল। এমনভাবে দিল যেন নিবারণকে উঠে গিয়ে আনতে হয়। নিবারণ তাই করল। জলিল বলল, অখন করবেন কী আপনে?
করনের কিছু নাই। কালনাগের বিষ।
কালনাগের না হইয়া অন্য সাপের হইলে, পারতেন?
নিবারণ জবাব দিল না। জলিল কড়া গলায় বলল, শিং মাছের বিষ নামানির ক্ষ্যামতাও আপনের নাই।
এইটা কেন কথা কন?
যে সত্যি, হেইডা কই।
আমি নিজ থাইক্যা তো বাবাজি আসি নাই। তুমি গিয়া আমারে আনছ।
বেকুবি করছি।
বাজান, অখন আমার বাড়িত যাওন দরকার। শইলটা যুত নাই। খুব বেযুত।
রুগী মরে-মরে, আপনের বাড়িত যাওনের চিন্তা।
বইয়া থাইক্যা লাভ নাই।
বইয়া থাকতে আপনেরে কয় কে? মন্ত্রট পড়েন। কড়ি চালান দেন। কড়ি চালান জানেন?
নিবারণ লাল চোখে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা তাকে অপমান করার চেষ্টা করছে। এটা নতুন কিছু না। অতীতে তার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। হয়তো রুগীর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মন্ত্রন্ত্র পড়া শুরু করার কিছুক্ষণ পরই রুগীর চোখ উল্টে গেছে। রুগীর আত্মীয়স্বজন চড়াও হয়েছে তার উপর যেন মৃত্যুর দায়ভাগ তার। যেন সে সাপকে শিখিয়ে দিয়েছে একে কাটবার জন্যে।
এখানেও তাই হবে। আগের ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের মনে নাই। মানিগণ্যিও নাই। বিশ্বাসের বড় অভাব। বিশ্বাস ছাড়া এই দুনিয়ার কিছু হয় না। নিবারণ উদাস গলায় বলল, জলিল ভাই, আমারে দিয়া আসনের ব্যবস্থা করেন। শইলডা খারাপ।
কী যে পাগলের কথা ক! দিনের অবস্থা দেখেন। কে দিয়া আইব?
যে আমারে আনছে, হে।
আমার খেতে যাওন লাগব। এই যে আইয়া বইলাম, না-পাইরা বইলাম। দোস্ত মানুষ মইরা যাইতাছে।
তয়, আমি যাই ক্যামনে?
জলিল তার জবাব না-দিয়ে উঠে গেল। অনেকখানি সময় সে এখানে কাটিয়েছে। উচিত হয় নি। সে বসে থাকায় মনিরের কোন লাভ হয় নি।
নিবারণ তাকিয়ে দেখল, জলিল হনহন করে যাচ্ছে। এক বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। বিশ্বাস মানুষের মন থেকে উঠে গেছে। মানুষের মনে ভক্তি নাই, শ্রদ্ধা নাই, কিছুই নাই। মানুষগুলি এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? নিবারণ তলপেটে ব্যথা অনুভব করল। প্ৰচণ্ড খিদে লেগেছে। খিদে লাগলেই পেটে ব্যথা হয়। বমি-বমি ভাব হয়। দিন বোধহয় শেষ। সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। গা থেকে খুলে-ফেলা ফতুয়াটি ভাঁজ করে কাঁধে রাখল। খাওয়ার জোগাড়ের ব্যবস্থা দেখা দরকার। সাপে-কাটা বাড়িতে রান্না হয় না, কিন্তু অন্য বাড়ি থেকে খাওয়া আসতে দোষ নাই। সেই দিকে কারো নজর নাই। তার দিকে কে নজর দেবে?
নিবরণ উঁচু গলায় বলল, মা লক্ষ্মী, একটু জল দেও।
শরিফা বের হয়ে এল। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের একটা জগ। নিবারণ নিচু গলায় বলল, বাড়ির ভিতরে গিয়া কন, আমি বিদায় নিছি। বহু দূরের পথ।
শরিফা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, যাইবেন ক্যান? কিছু করনের নাই। কালনাগের দংশন।
শরিফা শীতল গলায় বলল, রুগী ভালো আছে। আপনে যাইয়েন না, থাকেন। ভালো কইরা ঝাড়েন।
নিবারণ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বলে কী এই মেয়ে! রুগী নাকি ভালো আছে। এতক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
কী কইলা?
রুগী ভালো আছে। ভিতরে আইস্যা দেখেন।
কও কী তুমি!
খাওয়াদাওয়া করেন। ভালো কইরা ঝাড়েন।
তুমি রুগীর কে হও? পরিবার?
শরিফা মাথা নাড়ল।
যে-ঝাড়া দিছি, এর উপরে ঝাড়া নাই। কি করবা কও? মাইনষের বিশ্বাস নাই। বুঝলা, এই নিবারণের ঝাড়ার কারণে তিন দিনের মড়া হাঁইট্টা বাড়ি গেছে। আমার ওস্তাদ ছিল……পাপমুখে তার নাম নেওন যায় না। কিন্তু মা, এই ওস্তাদের নামে দোহাই দিলে অখনও বিষ আটকায়া যায়।
দেন, আপনে ওস্তাদের নামে দোহাই দেন।
পাপমুখে তার নাম নেওন যায় না মা লক্ষ্মী। আমি পাপী মানুষ।
না, আপনের উপরে আল্লাহ্র কিরা লাগে।
শরিফা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। নিবারণের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহা রে, বাচ্চা মেয়ে, কী কষ্টের মধ্যে পড়ছে। সে উদাস গলায় বলল, কাইলো না, ব্যবস্থা করছি। চিন্তার কিছু নাই। কালা গাইয়ের দুধ আরেক বাটির জোগাড় দেখ। বিষের গতিকটা দেখি।
অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে নিবারণ মুখে পানি ছিটাতে লাগল। শরিফা বলল, রুগীর সঙ্গে কথা কইবেন?
কথা? কথা কওনের অবসর নাই। মেলা কাম বাকি।
নিবারণ লাল গামছা মাথায় জড়িয়ে দিল। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও এখন তার মধ্যে নেই। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। আশেপাশে লোজন বিশেষ নেই। কয়েকটা ছেলে-ছোকরা। তাতে কিছুই যায়-আসে না। চড়কির মতো সে তার ডান হাত ঘোরাতে শুরু করল–
ও বিষ বিষ রে
কালনাগের বিষ রে।
শীশ নাগের ইস রে
মা মনসার রীশ রে–
এর বাড়িতে আইস না,
আসমান জমিন চাইস না
তোর পায়ে ধইরা সতী বেহুলা কান্দে রে।
এতগুলি মানুষ মাঠে কাজ করছে
এতগুলি মানুষ মাঠে কাজ করছে, এটা বোঝর কোনো উপায় নেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ধান কাটার ব্যাপারটায় অনেকখানি আনন্দ আছে। ধানের গোছা স্পর্শ করায় আনন্দ, তার ঘ্রাণে আনন্দ। এই সময়টায় শিশুরা সারা মাঠে ছোটাছুটি করে। বাবারা কপট রাগের ভঙ্গিতে ধমক দেয়-দামালি করি না। শিশুরাও টের পায় এটা কপট রাগ। তারা আরো হৈচৈ করে।
কিন্তু আজকের পরিবেশ ভিন্ন। এক দল ধান কাটছে, অন্য দল কাটা ধান অতি দ্রুত ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে তাকানোর অবসর নেই। তবু এরা মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। যত বার তাকাচ্ছে ততবারই তাদের মুখে শঙ্কার ছায়া গাঢ়তর হচ্ছে।