চিন্তাটা উল্টো দিকে যাচ্ছে। খবির হোসেন নিজেকে সামলে নিয়ে দোয়া করতে বসলেন। মনিরউদ্দিনের কথা আল্লাহ্কে গুছিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর চোখ ভিজে উঠল।
অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, মনিরউদ্দিন ছোকরা তাঁকে দেখতে পারে না। রাস্তায় দেখা হলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। একদিন তিনি বলেই ফেললেন, রাস্তায় দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তুমি আমারে সালাম দেও না, বিষয় কি কও দেখি?
মনিরউদ্দিন মুখ শক্ত করে থাকে। উত্তর দেয় না।
সালাম দেওয়া হজরতের সুন্নত। সুন্নত পালন না করলে কঠিন আজাব। পুলছিরাত পার হওন দায়। জিনিসটা খিয়াল রাখবা। আরেকটা কথা, নামাজে সামিল হও না কেন?
কাজকাম নিয়া থাকি।
তা তো থাকবাই। কৃষিকাজ হইল গিয়া তোমার ফরজে কিফা। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহপাকের সামনে খাড়া হওয়াও বড় ফরজ। খিয়াল রাখবা। দুই কান্দে দুই ফিরিশতা। বিনা কালির কলমে তারা লিখছে। মহাবিপদ সামনে।
তাতে কোনো লাভ হয় নি। এর পরও মনিরউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে মুখ শক্ত করে রেছেছে। তিনি নিজেই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ মনির?
জ্বি ভালো।
ভালো থাকলেই ভালো। তোমার বৌটা ভালো?
হুঁ।
আইচ্ছা আইচ্ছা, খুশির কথা। যার একদিন তোমার বাড়িতে।
মনির কিছু বলে না। এইসব ক্ষেত্রে ভদ্রতা করে হলেও আসবার কথা বলতে হয়। তার সে বালাইও নেই। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণ ছাড়া মানুষ কিছু করে না। কারণটা জানতে ইচ্ছা করে।
খবির হোসেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন, সেই অবস্থায় এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন, এবং ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ একটি দুঃস্বপ্ন দেখলেন। ঘামে তাঁর গা ভিজে গেল। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো হল। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
সুরা এখলাস পড়ে বুকে ফুঁ
খবির হোসেন সুরা এখলাস পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন।
তাঁর স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটে নি। বুক ধড়ফড় করছে। পানির পিপাসা হচ্ছে। অ্যালুমিনিয়ামের একটি জগে খাবার পানি থাকে। তাঁর কেন যেন মনে হল পানি নেই। আসলেই তাই, জগ শূন্য। তাঁর পিপাসা আরো বেড়ে গেল। তিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন। এমন লাগছে কেন চারদিক? নাকি এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন? কেমন যেন থমথম করছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। অনেক উঁচুতে চক্রাকারে ছিল উড়ছে।
তিনি এ-অঞ্চলের মানুষ নন। এখানে দীর্ঘদিন ধরে আছেন, তবু এ-অঞ্চলের আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি ধরতে পারেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল, সামনে দুঃসময়। একটি প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি সব শেষ করে দিতে পারে। একটি ভারি বর্ষণ মানেই শস্যশূন্য একটি দীর্ঘ বৎসর। স্বপ্নে কি এর ইঙ্গিতই ছিল? খবির হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মালুদ, ইয়া রাহমানুর রহিম।
মনিরউদ্দিনের বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ কেন ছিল না, এখন তা বুঝতে পারছেন। ফসল কাটা শুরু হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শস্য ঘরে তুলতে হবে। মানুষগুলির এখন কোনো বোধশক্তি নেই, এরা কাজ করছে যন্ত্রের মতো। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়েই আরো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ সব
স্মৃতি আছে তাদের সেই সব নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে।
আছরের নামাজের সময় কি হয়ে গেল? মেঘে সূর্য ঢাকা পড়েছে। সময় বোঝর উপায় নেই। আজান দেবেন, নাকি অপেক্ষা করবেন আরো খানিকক্ষণ। তিনি মসজিদের বারান্দায় উবুহয়ে বসে রইলেন। ভাবতে লাগলেন স্বপ্নটার কথা। স্বপুটা এরকম তিনি যেন বাইরে কোথাও যাবেন। আচকান গায়ে দিয়ে জুতা পরবার জন্যে নিচু হয়েছেন, অমনি গলায় কি যেন ফাঁসের মতো আটকে গেল। প্রথমে হালকাভাবে, কিন্তু ক্রমেই তা শক্ত হয়ে এঁটে বসতে শুরু করল। তিনি হাত দিয়ে তা ছাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। জিনিসটি দারুণ পিছল। হঠাৎ তাঁর মনে হল এটা বোধহয় সাপ। আর তখনি সাপটি কানের কাছে ছোবল বসিয়ে দিল। তীব্র ব্যথায় জেগে উঠে তিনি বুঝলেন স্বপ্ন দেখছেন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, কানের কাছের জায়গাটা এখনো ফুলে আছে, ব্যথা করছে। সম্ভবত কাঠপিপড়ের কামড়। স্বপ্নে ছোটখাটো জিনিস অনেক বড় হয়ে আসে।
খবির হসেন উঠে দাঁড়ালেন বাড়ি ফিরে যাবেন। পানি পিপাসায় এখন সত্যিসত্যি কাতর হয়েছেন। আছরের আজান দেওয়া হল না। দেওয়া ঠিক হবে না। অজু নেই। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গাঢ় ঘুম হয়েছে। গাঢ় ঘুমে অজু নষ্ট হয়ে যায়।
পথ জনশূন্য। সব মাঠে চলে গিয়েছে। অথচ তিনি কিছুই জানেন না। এরা তাঁকে কিছুই বলে নি। এরা নিশ্চয়ই ভোরবেলাতেই টের পেয়েছে। মেঘ-বৃষ্টির ব্যাপারগুলি এরা খুব ভালো জানে। একবার বৈশাখ মাসে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ এল, দেখেই মনে হচ্ছে পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাবে। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, অথচ গ্রামের মানুষ নির্বিকার। তারা হাসিমুখে বলেছে, এইটা হইল দেখন মেঘ। শক্ত বাতাস দিব। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ব। ব্যস।
আসলেই তাই। এরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলে। প্রকৃতির উপর যাদের এত নির্ভর তাদের তো প্রকৃতিকে বুঝতেই হবে।
কিন্তু এরা কেউ তাঁকে কিছু বলল না কেন? তিনি কি এদেরই একজন না? এদের সুখ-দুঃখ কি তাঁর সুখ-দুঃখ নয়? অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, কোথাও কেউ তাঁকে আপন করে নেয় নি। দেশে-দেশে ঘুরে জীবন কাটল। যখন যেখানে ছিলেন, তাদের কথাই ভেবেছেন। আল্লাহপাকের কাছে খাস দিলে তাদের জন্যে মোনাজাত করেছেন। তাতে লাভ কী হয়েছে? কেন এই গ্রামের একটি লোক তাঁকে দৌড়ে এসে বলল না—মৌলানা সাব, আমরার বড় বিপদ, আপনে দোয়া-খায়ের করেন।